সৃজনশীল প্রশ্ন
'জীবন-বন্দনা'
নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বর্গাচাষি জবুর দুই দিন ধরে বাড়ির উত্তরের টিলা পরিষ্কার করে সেখানে বাহারি ফলের গাছ লাগায়। একটানা খাটুনিতে হাতে কড়া পড়ে। গায়ে জ্বর, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলে দীপ্রর কথা ভাবে_'মা-মরা পোলাডা শহরে থাইকা বিএ পাস দিছে, এমএ পাস দিলে জবুরের পরিশ্রম সার্থক অইব।' এসব কথা ভেবে তার বুকটা ভরে ওঠে। মুখে হাসি নিয়ে স্বগতোক্তি করে, 'পোলা অইছে আমার মতো প্রতিবাদী; অন্যায় করলে কাউরে ছাইরা কতা কয় না!' বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময় ঘরে ঢোকে নিখিল_চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, 'চাচা! দীপ্র ভাইয়া সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে গোলাগুলিতে মারা গেছে!' জবুরের বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে, বোবার মতো গোঙানিতে শুধু বাবা রে! ...বা...বা! বলতে বলতে তার নিথর দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ক) তরুণদের কূপমণ্ডূকেরা কী আখ্যা দিয়েছে?
খ) ধরণীর হাতে কারা ফসলের ফরমান এনে দিল?
গ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা করেছেন উদ্দীপকের জবুর তারই প্রতিনিধি /দর্পণ'_ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
ঘ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে কারণে যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন উদ্দীপকের দীপ্র যেন তারই প্রতিনিধি/দর্পণ/প্রতিচ্ছবি'_মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করো/মূল্যায়ন করো/বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : ক) তরুণদের কূপমণ্ডূকেরা 'অসংযমী' বলে আখ্যা দিয়েছে।
খ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি শ্রমজীবী মানুষের এবং যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন।
শ্রমজীবী সংগ্রামী মানুষ পৃথিবীর হাতে ফসলের খবর তুলে দিয়েছে। অর্থাৎ কবি সেসব কৃষকের জয়গান গাইছেন যারা মাটির বুকে ফসল ফলায়। কৃষকের দৃঢ় কঠিন হাতের কবলে পড়ে পৃথিবীর মাটি যেন ফুল, ফল ও ফসলের উপঢৌকন দিতে বাধ্য হয়েছে। এই শ্রমনিষ্ঠ মেহনতি মানুষের রক্ত ও ঘামের বিনিময়েই পৃথিবী অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুঙ্কর হয়ে উঠেছে।
গ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি শ্রমজীবী মানুষের এবং যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন। শ্রমশীল মানুষ তার কঠোর শ্রম-সাধনায় প্রকৃতির বুকে ফসল ফলিয়েছে, ধরণীকে করেছে অমরাবতী। 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা করেছেন উদ্দীপকের জবুর তারই প্রতিনিধি, তারই প্রতিচ্ছবি।
কবিতার প্রথম স্তবকের শুরুতেই কবি উচ্চারণ করেছেন_'গাহি তাহাদের গান_'। এই 'তাহারা' হলো শ্রমজীবী সংগ্রামী মানুষ। যেসব শ্রমনিষ্ঠ মেহনতি মানুষের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে পৃথিবী অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুঙ্কর হয়ে উঠেছে সেই মেহনতের 'শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন' চিহ্নই বহন করছে উদ্দীপকের জবুর। যে শ্রমশীল কৃষকের দৃঢ় কঠিন হাতের কবলে পড়ে পৃথিবীর মাটি, ফুল, ফল ও ফসলের উপঢৌকন দিতে বাধ্য হয়েছে সেসব সংগ্রামী শ্রমজীবীর প্রতিনিধি জবুর তার বাড়ির উত্তরের টিলা পরিষ্কার করে সেখানে বাহারি ফলের গাছ লাগিয়ে ফুলে-ফলে ভরে তুলেছে। সৃষ্টির আদিতে এই পৃথিবী ছিল হিংস্র বন্যজন্তু আর পাহাড়-পর্বত ও গভীর অরণ্যে পরিপূর্ণ। 'শ্বাপদ-সঙ্কুল' এই পৃথিবীর কাছে মানুষ হার মানেনি, বরং অক্লান্ত শ্রমসাধনায় সেই 'জরা-মৃত্যু-ভীষণা' পৃথিবীকে 'কুসুমিতা মনোহরা' করে তুলেছে। জবুরও দিনের পর দিন টিলা পরিষ্কার করে হাতে কড়া ফেলে দিয়েছে, অবশেষে গায়ে জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়েছে, তবু হার মানেনি। 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি মূলত সেসব শ্রমনিষ্ঠ ও মেহনতি মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন; যাদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে পৃথিবী অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুঙ্কর হয়ে উঠেছে। আর জবুরের বন্দনাগীত তার ছেলেকে ঘিরে। সংকীর্ণচিত্ত লোকেরা যেসব কৃষক, মজুরের অসভ্য, অশিক্ষিত বলে গালাগাল দেয় জবুর তাদের বিরুদ্ধে উদ্ধত-শির, বিদ্রোহী সত্তা। সে তার ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে তার শ্রম-সাধনাকে সার্থক করতে চায়। জবুর মানবমুক্তি ও কল্যাণে 'ধরণী-মেরীর যিশু'র মতোই আত্মাহুতি দিয়েছে। বস্তুত "জবুর এবং 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় বর্ণিত শ্রমজীবী মানুষগুলো অভিন্ন সূত্রে গাঁথা।"
ঘ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় চির-যৌবনের পূজারি কবি কাজী নজরুল ইসলাম শ্রমজীবী মানুষ এবং যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন।
চির-যৌবনের কবি নজরুলের 'জীবন-বন্দনা' প্রকৃতপক্ষে 'যৌবন-বন্দনা'। কারণ কবির দৃষ্টিতে যৌবন জীবনের এবং জরা-মৃত্যুর নামান্তর। যে যৌবন এ পৃথিবীকে জীবন দিয়েছে, ফুলে-ফলে শোভিত করেছে, যে তারুণ্যশক্তি নিত্যনতুন সৃষ্টির উল্লাসে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নির্ভয়ে ছুটে চলে তাদের বন্দনায় মুখর 'জীবন-বন্দনা' কবিতাটি। প্রকৃতপক্ষে কবি যে কারণে যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন। উদ্দীপকে তার দীপ্তোজ্জ্বল প্রতিফলন দেখতে পাই।
কবি তারুণ্যের সেই শক্তিকে বন্দনা করেন যারা অসীম সাহস ও বিপুল প্রাণশক্তি নিয়ে দুর্লঙ্ঘ পর্বত জয় করে, সাগরকে ভরাট করে নগর গড়ে, মেরুর বুকে অভিযান চালায়, আকাশ জয়ে ছুটে যায় গ্রহ-গ্রহান্তরে। প্রকৃত প্রস্তাবে, কবি তারুণ্যের সেই শক্তিকে বন্দনা করেছেন যে তারণ্যশক্তি অপ্রতিরোধ্য, অকুতোভয়, দুঃসাহসী ও দুর্বিনীত। তারুণ্যের এসব বৈশিষ্ট্যে দীপ্র সমুজ্জ্বল। দীপ্রর বাবার স্বগতোক্তিতেই দীপ্র আমাদের কাছে চির-যৌবনশক্তির সর্বজনীন চরিত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। দীপ্র তার বাবার মতোই পরিশ্রমী সাধক এবং প্রতিবাদী। দীপ্রকে আমরা দেখি দৈনন্দিন জীবনে, পথে-ঘাটে-ঘরে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, যৌবনশক্তিকে জেগে উঠতে দেখি বিভিন্ন মিছিলে, আন্দোলনে। দেখি, 'ভীম রণভূমে প্রাণ বাজি রেখে হার'তে কিংবা গুলি খেয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়তে। কবি তো মানবের মুক্তিসংগ্রামে আগুয়ান সেই শক্তিরই জয়গান গেয়েছেন, যারা মানবমুক্তির পথে কোনো বাধা মানে না। নির্দ্বিধায় আত্মাহুতি দেয় বিপ্লবী সংগ্রামে। যে সংগ্রামে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছে তেজোদীপ্ত যুবক দীপ্র। এ যেন দুরন্ত সংগ্রামের আরেক রূপ, নজরুলের যৌবন-বন্দনার নতুন তূর্যবাদক বীরসেনানী। দীপ্র বৃহত্তর মানব-মঙ্গলের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে প্রাণ হারায়। তারুণ্যের এই আত্মোৎসর্গে কবির অন্তর প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, কবি আবেগময় কণ্ঠে সেই অসম সাহসীদের বন্দনাগীত উচ্চারণ করেন_'তারাই গাহিল নব প্রেম-গান ধরণী-মেরীর যিশু'।
যৌবনের যে অশান্ত, অক্লান্ত, দুরন্ত, দুর্বিনীত আবেগ ও উল্লাস 'জীবন-বন্দনা' কবিতাটিতে দৃশ্যমান তা একুশ শতকের মানুষের আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের কাব্যরূপ। যদিও দীপ্র নবজগতের দূর সন্ধানী অসীমের পথে, সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভ-অভিযানে যায়নি, তথাপি কবির কাছে যৌবনের যে মহিমা এবং গতিময় জীবনে দুঃসাহসী যৌবনের যে বিচিত্র রূপ কবি প্রত্যক্ষ করেছেন তা স্পষ্টতই দীপ্রর মধ্যে নিহিত। 'শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন' হাতে জবুর তার ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার আশায় 'ত্রস্তা ধরণী'র সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ছেলে দীপ্রও মেহনতি বাবার রক্ত ও ঘামের মূল্য দিতেই দুঃসহ বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রাম করে 'অমিত বেগে' এগিয়ে চলছে। কিন্তু 'জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি' দীপ্র সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে গুলি খেয়ে মরেছে; এ যেন 'সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে!' কবি তো দীপ্রর মতো এই যৌবনশক্তিরই জয়গান করেন, বলেছে, 'তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।' প্রকৃত প্রস্তাবে, "দীপ্র যেন 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন_তারই প্রতিচ্ছবি।"
নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বর্গাচাষি জবুর দুই দিন ধরে বাড়ির উত্তরের টিলা পরিষ্কার করে সেখানে বাহারি ফলের গাছ লাগায়। একটানা খাটুনিতে হাতে কড়া পড়ে। গায়ে জ্বর, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলে দীপ্রর কথা ভাবে_'মা-মরা পোলাডা শহরে থাইকা বিএ পাস দিছে, এমএ পাস দিলে জবুরের পরিশ্রম সার্থক অইব।' এসব কথা ভেবে তার বুকটা ভরে ওঠে। মুখে হাসি নিয়ে স্বগতোক্তি করে, 'পোলা অইছে আমার মতো প্রতিবাদী; অন্যায় করলে কাউরে ছাইরা কতা কয় না!' বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময় ঘরে ঢোকে নিখিল_চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, 'চাচা! দীপ্র ভাইয়া সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে গোলাগুলিতে মারা গেছে!' জবুরের বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে, বোবার মতো গোঙানিতে শুধু বাবা রে! ...বা...বা! বলতে বলতে তার নিথর দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ক) তরুণদের কূপমণ্ডূকেরা কী আখ্যা দিয়েছে?
খ) ধরণীর হাতে কারা ফসলের ফরমান এনে দিল?
গ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা করেছেন উদ্দীপকের জবুর তারই প্রতিনিধি /দর্পণ'_ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
ঘ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে কারণে যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন উদ্দীপকের দীপ্র যেন তারই প্রতিনিধি/দর্পণ/প্রতিচ্ছবি'_মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করো/মূল্যায়ন করো/বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : ক) তরুণদের কূপমণ্ডূকেরা 'অসংযমী' বলে আখ্যা দিয়েছে।
খ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি শ্রমজীবী মানুষের এবং যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন।
শ্রমজীবী সংগ্রামী মানুষ পৃথিবীর হাতে ফসলের খবর তুলে দিয়েছে। অর্থাৎ কবি সেসব কৃষকের জয়গান গাইছেন যারা মাটির বুকে ফসল ফলায়। কৃষকের দৃঢ় কঠিন হাতের কবলে পড়ে পৃথিবীর মাটি যেন ফুল, ফল ও ফসলের উপঢৌকন দিতে বাধ্য হয়েছে। এই শ্রমনিষ্ঠ মেহনতি মানুষের রক্ত ও ঘামের বিনিময়েই পৃথিবী অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুঙ্কর হয়ে উঠেছে।
গ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি শ্রমজীবী মানুষের এবং যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন। শ্রমশীল মানুষ তার কঠোর শ্রম-সাধনায় প্রকৃতির বুকে ফসল ফলিয়েছে, ধরণীকে করেছে অমরাবতী। 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা করেছেন উদ্দীপকের জবুর তারই প্রতিনিধি, তারই প্রতিচ্ছবি।
কবিতার প্রথম স্তবকের শুরুতেই কবি উচ্চারণ করেছেন_'গাহি তাহাদের গান_'। এই 'তাহারা' হলো শ্রমজীবী সংগ্রামী মানুষ। যেসব শ্রমনিষ্ঠ মেহনতি মানুষের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে পৃথিবী অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুঙ্কর হয়ে উঠেছে সেই মেহনতের 'শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন' চিহ্নই বহন করছে উদ্দীপকের জবুর। যে শ্রমশীল কৃষকের দৃঢ় কঠিন হাতের কবলে পড়ে পৃথিবীর মাটি, ফুল, ফল ও ফসলের উপঢৌকন দিতে বাধ্য হয়েছে সেসব সংগ্রামী শ্রমজীবীর প্রতিনিধি জবুর তার বাড়ির উত্তরের টিলা পরিষ্কার করে সেখানে বাহারি ফলের গাছ লাগিয়ে ফুলে-ফলে ভরে তুলেছে। সৃষ্টির আদিতে এই পৃথিবী ছিল হিংস্র বন্যজন্তু আর পাহাড়-পর্বত ও গভীর অরণ্যে পরিপূর্ণ। 'শ্বাপদ-সঙ্কুল' এই পৃথিবীর কাছে মানুষ হার মানেনি, বরং অক্লান্ত শ্রমসাধনায় সেই 'জরা-মৃত্যু-ভীষণা' পৃথিবীকে 'কুসুমিতা মনোহরা' করে তুলেছে। জবুরও দিনের পর দিন টিলা পরিষ্কার করে হাতে কড়া ফেলে দিয়েছে, অবশেষে গায়ে জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়েছে, তবু হার মানেনি। 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি মূলত সেসব শ্রমনিষ্ঠ ও মেহনতি মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন; যাদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে পৃথিবী অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুঙ্কর হয়ে উঠেছে। আর জবুরের বন্দনাগীত তার ছেলেকে ঘিরে। সংকীর্ণচিত্ত লোকেরা যেসব কৃষক, মজুরের অসভ্য, অশিক্ষিত বলে গালাগাল দেয় জবুর তাদের বিরুদ্ধে উদ্ধত-শির, বিদ্রোহী সত্তা। সে তার ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে তার শ্রম-সাধনাকে সার্থক করতে চায়। জবুর মানবমুক্তি ও কল্যাণে 'ধরণী-মেরীর যিশু'র মতোই আত্মাহুতি দিয়েছে। বস্তুত "জবুর এবং 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় বর্ণিত শ্রমজীবী মানুষগুলো অভিন্ন সূত্রে গাঁথা।"
ঘ) 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় চির-যৌবনের পূজারি কবি কাজী নজরুল ইসলাম শ্রমজীবী মানুষ এবং যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন।
চির-যৌবনের কবি নজরুলের 'জীবন-বন্দনা' প্রকৃতপক্ষে 'যৌবন-বন্দনা'। কারণ কবির দৃষ্টিতে যৌবন জীবনের এবং জরা-মৃত্যুর নামান্তর। যে যৌবন এ পৃথিবীকে জীবন দিয়েছে, ফুলে-ফলে শোভিত করেছে, যে তারুণ্যশক্তি নিত্যনতুন সৃষ্টির উল্লাসে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নির্ভয়ে ছুটে চলে তাদের বন্দনায় মুখর 'জীবন-বন্দনা' কবিতাটি। প্রকৃতপক্ষে কবি যে কারণে যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন। উদ্দীপকে তার দীপ্তোজ্জ্বল প্রতিফলন দেখতে পাই।
কবি তারুণ্যের সেই শক্তিকে বন্দনা করেন যারা অসীম সাহস ও বিপুল প্রাণশক্তি নিয়ে দুর্লঙ্ঘ পর্বত জয় করে, সাগরকে ভরাট করে নগর গড়ে, মেরুর বুকে অভিযান চালায়, আকাশ জয়ে ছুটে যায় গ্রহ-গ্রহান্তরে। প্রকৃত প্রস্তাবে, কবি তারুণ্যের সেই শক্তিকে বন্দনা করেছেন যে তারণ্যশক্তি অপ্রতিরোধ্য, অকুতোভয়, দুঃসাহসী ও দুর্বিনীত। তারুণ্যের এসব বৈশিষ্ট্যে দীপ্র সমুজ্জ্বল। দীপ্রর বাবার স্বগতোক্তিতেই দীপ্র আমাদের কাছে চির-যৌবনশক্তির সর্বজনীন চরিত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। দীপ্র তার বাবার মতোই পরিশ্রমী সাধক এবং প্রতিবাদী। দীপ্রকে আমরা দেখি দৈনন্দিন জীবনে, পথে-ঘাটে-ঘরে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, যৌবনশক্তিকে জেগে উঠতে দেখি বিভিন্ন মিছিলে, আন্দোলনে। দেখি, 'ভীম রণভূমে প্রাণ বাজি রেখে হার'তে কিংবা গুলি খেয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়তে। কবি তো মানবের মুক্তিসংগ্রামে আগুয়ান সেই শক্তিরই জয়গান গেয়েছেন, যারা মানবমুক্তির পথে কোনো বাধা মানে না। নির্দ্বিধায় আত্মাহুতি দেয় বিপ্লবী সংগ্রামে। যে সংগ্রামে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছে তেজোদীপ্ত যুবক দীপ্র। এ যেন দুরন্ত সংগ্রামের আরেক রূপ, নজরুলের যৌবন-বন্দনার নতুন তূর্যবাদক বীরসেনানী। দীপ্র বৃহত্তর মানব-মঙ্গলের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে প্রাণ হারায়। তারুণ্যের এই আত্মোৎসর্গে কবির অন্তর প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, কবি আবেগময় কণ্ঠে সেই অসম সাহসীদের বন্দনাগীত উচ্চারণ করেন_'তারাই গাহিল নব প্রেম-গান ধরণী-মেরীর যিশু'।
যৌবনের যে অশান্ত, অক্লান্ত, দুরন্ত, দুর্বিনীত আবেগ ও উল্লাস 'জীবন-বন্দনা' কবিতাটিতে দৃশ্যমান তা একুশ শতকের মানুষের আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের কাব্যরূপ। যদিও দীপ্র নবজগতের দূর সন্ধানী অসীমের পথে, সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভ-অভিযানে যায়নি, তথাপি কবির কাছে যৌবনের যে মহিমা এবং গতিময় জীবনে দুঃসাহসী যৌবনের যে বিচিত্র রূপ কবি প্রত্যক্ষ করেছেন তা স্পষ্টতই দীপ্রর মধ্যে নিহিত। 'শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন' হাতে জবুর তার ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার আশায় 'ত্রস্তা ধরণী'র সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ছেলে দীপ্রও মেহনতি বাবার রক্ত ও ঘামের মূল্য দিতেই দুঃসহ বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রাম করে 'অমিত বেগে' এগিয়ে চলছে। কিন্তু 'জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি' দীপ্র সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে গুলি খেয়ে মরেছে; এ যেন 'সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে!' কবি তো দীপ্রর মতো এই যৌবনশক্তিরই জয়গান করেন, বলেছে, 'তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।' প্রকৃত প্রস্তাবে, "দীপ্র যেন 'জীবন-বন্দনা' কবিতায় কবি যে যৌবনশক্তির জয়গান গেয়েছেন_তারই প্রতিচ্ছবি।"
No comments:
Post a Comment