একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী : বাংলা প্রথম পত্রসৃজনশীল প্রশ্ন
হৈমন্তী
নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
গল্প আকারে ছোট হলেই ছোটগল্প হয় না। জীবনের পূর্ণাবয়ব আলোচনা নয়, জীবনের খণ্ডাংশকে লেখক যখন রস-নিবিড় করে ফোটাতে পারেন, তখনই এর সার্থকতা। জীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত কোনো বিশেষ পরিবেশের মধ্যে যেমনভাবে লেখকের কাছে প্রতিভাসিত হয়, ছোটগল্প তারই রূপায়ণ। তত্ত্ব, উপদেশহীন স্বল্পসংখ্যক চরিত্র ও সুনির্দিষ্ট ঘটনার ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি ছোটগল্পের উদ্দেশ্য। গল্পের শুরু ও শেষ হয় আকস্মিক; যেমনটি লক্ষ করা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্পের শেষদিকে_'ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই।'
ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত সালে নোবেল পুরস্কার পান?
অথবা, 'হৈমন্তী' গল্পের উৎস কী?
খ) 'আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির'_শিশির নাম রাখার তাৎপর্য কী?
গ) 'ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই।'_ছোটগল্প রূপায়ণে উক্তিটি কতখানি প্রযোজ্য যৌক্তিক উত্তর উপস্থাপন করো। অথবা উক্তিটিতে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের আলোকে উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
ঘ) উদ্দীপকে বর্ণিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী 'হৈমন্তী' ছোটগল্প হিসেবে কতটা সার্থক হয়েছে বলে তুমি মনে করো? যৌক্তিক উত্তর উপস্থাপন করো।
উত্তর : ক) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান।
(অথবা উত্তর) : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হৈমন্তী' গল্পটি প্রথমে 'গল্প সপ্তক' গ্রন্থে (১৯১৬ খ্রি.) সংকলিত হয়েছিল। পরে 'গল্পগুচ্ছ' তৃতীয় খণ্ডে (১৯২৬ খ্রি.) সনি্নবেশিত হয়।
খ) 'তাহার নাম দিলাম শিশির'_উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হৈমন্তী' গল্পের নায়ক অপুর।
অপু তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জীবনের করুণ পরিণতি নিয়ে গল্প লেখার সময় ক্ষণস্থায়িত্বের প্রতীক হিসেবে তার স্ত্রীর নাম 'শিশির' বলে আখ্যায়িত করেছে। শিশির বিন্দুর মতোই হৈমন্তী তৎকালীন হৃদয়হীন স্বার্থান্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির নিষ্ঠুর আচরণে আর তার স্বামীর নিশ্চেষ্ট অসহায়তার মুখে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় অনাদৃত হয়ে ছিন্ন করেছে পৃথিবীর মায়াজাল। ফলে অপু প্রথমে তার স্ত্রীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিল। কারণ যে তাম্রশাসনে তার নামটি খোদাই করা আছে সেটা অপুর নিজ হৃদয়পট। সে যে তার হৃদয়ের ধন, অমূল্য সম্পদ। তবু গল্পের খাতিরে তার নাম দেওয়া হয় শিশির। কারণ 'শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়।' অপুর স্ত্রী হৈমন্তীর প্রণয় ও বিচ্ছেদ হাসি-কান্নাতে পরিপূর্ণ। তাই হৈমন্তীর বিবাহোত্তর স্বল্পস্থায়ী বিষণ্ন করুণ জীবনখানি ভোরের ক্ষণস্থায়ী শিশিরের সঙ্গে তুলনীয় বলে অপু তার স্ত্রীর নাম দিয়েছিল শিশির।
গ) 'হৈমন্তী' ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হৈমন্তী বিশ্ববিজয়ী সত্যদ্রষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথের এক অপূর্ব সৃষ্টি। হৈমন্তীর মায়াবী হাসির আকর্ষণ আর শুভ্র সরল মনের উদারতা যেমন সহজেই পাঠক মনকে জয় করে, তেমনি অপু তার সাদাসিধে ফটোগ্রাফ দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল। আর গিরিনন্দিনী হৈমর ভাবী_বধূজীবনের যাত্রা শুরু এখান থেকেই।
হৈমন্তী ছিল শিক্ষিত ও সুরুচিসম্পন্ন। ফলে হৈমন্তীর মুখের হাসিতে একটি পরিচ্ছন্ন ভাব ও আন্তরিকতা ছিল। কোনো রকম জটিলতা বা কুটিল অভিব্যক্তি সেখানে ছিল না। হৈমন্তীর এই হাসিকে অপু বিধাতার দান বলে মনে করেছে। গল্পজুড়ে তার স্নিগ্ধ হাসির মায়াজালেই অপু আচ্ছন্ন ছিল।
শ্বশুরবাড়ির অমানুষিক নির্যাতন ও রূঢ় নির্মম নিষ্ঠুরতায় হৈমন্তীর দেহমন শুকিয়ে জর্জরিত হয়েছে। এমনকি অপুর সংশয় ও উৎকণ্ঠার মুখে হৈম তার নির্মল শুভ্র হাসির অন্তরালে ঢেকে দিয়েছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত যন্ত্রণাক্লিষ্ট হৃদয়ের ক্ষতকে। হৈমন্তীর এই হাসি আরো তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল যখন অসুস্থ হৈমকে তার বাবা দেখতে আসেন এবং হৈমকে নিজের কাছে নিতে চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হন। এমন নির্মম আচরণের মর্মপীড়ায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েও বিদায়ের সময় বাপ-মেয়ে দুজনেরই মুখে হাসি। কন্যা হাসিতে হাসিতেই ভৎর্সনা করিয়া বলিল, 'বাবা তুমি যদি এ বাড়িতে আবারও আস, তবে ঘরে কপাট দেব।' বাবাও হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, 'ফের যদি আসি তবে সিঁধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব।' বাপ-মেয়ের এই হাস্যোজ্জ্বল বিদায়ের পরে হৈমন্তীর মুখের 'চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও' দেখা যায়নি। বস্তুত এখানেই গল্পের ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি ঘটে। অপু নিজেও বলেছে যে 'তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর বলিতে পারিব না'। অপু না বললেও হৈমন্তীর ইঙ্গিতপূর্ণ করুণ পরিণতি পাঠক স্বতই অনুভব করতে পারে; যা ছোটগল্পের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আর এই ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন অপু বলে, 'শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো এক দিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ_থাক্ আর কাজ কী!' এভাবে পাঠকের মনে অসম্পূর্ণতার অতৃপ্তি রেখে গল্প শেষ হয়ে যায়; যা ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যকে সমুজ্জ্বল করেছে। উপযুক্ত যৌক্তিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথাটি দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে ছোটগল্প রূপায়ণে উদ্দীপকের উক্তিটি শতভাগ প্রযোজ্য এবং সার্থক।
ঘ) উদ্দীপকে ছোটগল্পের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে নির্দেশিত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ নিরূপণে আমরা উদ্দীপকের উদ্ধৃত উক্তিটিকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথের 'হৈমন্তী' একটি অনবদ্য ছোটগল্প। উদ্দীপকে নির্দেশিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বোঝা যায় যে ছোটগল্পের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে 'হৈমন্তী' গল্পটির আবেদন সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ হয়েছে।
উদ্দীপকে বলা হয়েছে যে ছোটগল্পে পূর্ণাবয়ব জীবনের প্রকাশ থাকে না বরং জীবনের খণ্ডাংশ রস-নিবিড় হয়ে ফুটে ওঠে। ছোটগল্পের এই বিশেষ লক্ষণটি 'হৈমন্তী' গল্পের নায়িকার জীবনের করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
'হৈমন্তী' সাধারণ এক পারিবারিক পরিমণ্ডলে অঙ্কিত_স্বভাবকোমল পবিত্র মাধুর্যময় লাবণ্যময়ী এক মেয়ের কাহিনী; যে যৌতুক প্রথার যূপকাষ্ঠে হয়েছে নির্মম বলি। হৃদয়হীন স্বার্থান্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির নিষ্ঠুর আচরণে আর তার স্বামীর নিশ্চেষ্ট অসহায়তার মুখে সরল শুভ্র হৈমন্তী কিভাবে বলি হয়েছিল, গল্পের বাস্তব পটভূমিকায় লেখক সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি ও অপূর্ব মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তারই চমকপ্রদ ছবি এঁকেছেন। গল্পের নায়িকা হৈমন্তী যৌতুক প্রথার যূপকাষ্ঠে নির্মম বলি হলেও গল্পের কোথাও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে কিংবা সমাজ সংশোধনের সপক্ষে কোনো তত্ত্বকথা বা উপদেশ দেওয়া হয়নি। যা উদ্দীপকে নির্দেশিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যকে মেনে চলেছে। আবার ছোটগল্পে স্বল্পসংখ্যক চরিত্র ও সুনির্বাচিত ঘটনার সাহায্যে গল্পের ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি দানই লেখকের উদ্দেশ্য হবে। 'হৈমন্তী' গল্পে অপু ও হৈমন্তীর বিয়ের উদ্যোগ ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে গল্পটি শুরু হয়েছে। তারপর থেকে ঘটনা লক্ষ্যভেদী তীরের মতো অব্যর্থ পরিণামের অভিমুখী হয়ে, সেই বিয়ের পরিণতি কী হয়েছিল ইঙ্গিতের মধ্য দিয়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আর এই হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী ঘটনাটি গল্পের নায়ক অপু নিজেই উপস্থাপন করেছে। ফলে 'হৈমন্তী' ছোটগল্প হিসেবে তার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে পেরেছে।
'হৈমন্তী' গল্পটি শেষ হয়েছে হঠাৎ পাঠকের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। 'শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো এক দিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ_থাক্ আর কাজ কী!' এভাবে পাঠকের মনে কৌতূহলের উদ্রেক করে কাহিনীর ইতি টানা হলেও পাঠককে তারপর অবশ্যই ভাবতে বসতে হয়। যা ছোটগল্প হিসেবে 'হৈমন্তী'-কে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। উপযুক্ত যৌক্তিক আলোচনায় উদ্দীপকে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ ও গঠনবৈশিষ্ট্য প্রয়োগে বলা যায়, 'হৈমন্তী' বাংলা সাহিত্যে একটি শিল্পসার্থক ছোটগল্প এবং এটি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃজন কীর্তির একটি অসামান্য স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।
নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
গল্প আকারে ছোট হলেই ছোটগল্প হয় না। জীবনের পূর্ণাবয়ব আলোচনা নয়, জীবনের খণ্ডাংশকে লেখক যখন রস-নিবিড় করে ফোটাতে পারেন, তখনই এর সার্থকতা। জীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত কোনো বিশেষ পরিবেশের মধ্যে যেমনভাবে লেখকের কাছে প্রতিভাসিত হয়, ছোটগল্প তারই রূপায়ণ। তত্ত্ব, উপদেশহীন স্বল্পসংখ্যক চরিত্র ও সুনির্দিষ্ট ঘটনার ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি ছোটগল্পের উদ্দেশ্য। গল্পের শুরু ও শেষ হয় আকস্মিক; যেমনটি লক্ষ করা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্পের শেষদিকে_'ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই।'
ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত সালে নোবেল পুরস্কার পান?
অথবা, 'হৈমন্তী' গল্পের উৎস কী?
খ) 'আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির'_শিশির নাম রাখার তাৎপর্য কী?
গ) 'ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই।'_ছোটগল্প রূপায়ণে উক্তিটি কতখানি প্রযোজ্য যৌক্তিক উত্তর উপস্থাপন করো। অথবা উক্তিটিতে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের আলোকে উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
ঘ) উদ্দীপকে বর্ণিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী 'হৈমন্তী' ছোটগল্প হিসেবে কতটা সার্থক হয়েছে বলে তুমি মনে করো? যৌক্তিক উত্তর উপস্থাপন করো।
উত্তর : ক) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান।
(অথবা উত্তর) : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হৈমন্তী' গল্পটি প্রথমে 'গল্প সপ্তক' গ্রন্থে (১৯১৬ খ্রি.) সংকলিত হয়েছিল। পরে 'গল্পগুচ্ছ' তৃতীয় খণ্ডে (১৯২৬ খ্রি.) সনি্নবেশিত হয়।
খ) 'তাহার নাম দিলাম শিশির'_উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হৈমন্তী' গল্পের নায়ক অপুর।
অপু তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জীবনের করুণ পরিণতি নিয়ে গল্প লেখার সময় ক্ষণস্থায়িত্বের প্রতীক হিসেবে তার স্ত্রীর নাম 'শিশির' বলে আখ্যায়িত করেছে। শিশির বিন্দুর মতোই হৈমন্তী তৎকালীন হৃদয়হীন স্বার্থান্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির নিষ্ঠুর আচরণে আর তার স্বামীর নিশ্চেষ্ট অসহায়তার মুখে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় অনাদৃত হয়ে ছিন্ন করেছে পৃথিবীর মায়াজাল। ফলে অপু প্রথমে তার স্ত্রীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিল। কারণ যে তাম্রশাসনে তার নামটি খোদাই করা আছে সেটা অপুর নিজ হৃদয়পট। সে যে তার হৃদয়ের ধন, অমূল্য সম্পদ। তবু গল্পের খাতিরে তার নাম দেওয়া হয় শিশির। কারণ 'শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়।' অপুর স্ত্রী হৈমন্তীর প্রণয় ও বিচ্ছেদ হাসি-কান্নাতে পরিপূর্ণ। তাই হৈমন্তীর বিবাহোত্তর স্বল্পস্থায়ী বিষণ্ন করুণ জীবনখানি ভোরের ক্ষণস্থায়ী শিশিরের সঙ্গে তুলনীয় বলে অপু তার স্ত্রীর নাম দিয়েছিল শিশির।
গ) 'হৈমন্তী' ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হৈমন্তী বিশ্ববিজয়ী সত্যদ্রষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথের এক অপূর্ব সৃষ্টি। হৈমন্তীর মায়াবী হাসির আকর্ষণ আর শুভ্র সরল মনের উদারতা যেমন সহজেই পাঠক মনকে জয় করে, তেমনি অপু তার সাদাসিধে ফটোগ্রাফ দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল। আর গিরিনন্দিনী হৈমর ভাবী_বধূজীবনের যাত্রা শুরু এখান থেকেই।
হৈমন্তী ছিল শিক্ষিত ও সুরুচিসম্পন্ন। ফলে হৈমন্তীর মুখের হাসিতে একটি পরিচ্ছন্ন ভাব ও আন্তরিকতা ছিল। কোনো রকম জটিলতা বা কুটিল অভিব্যক্তি সেখানে ছিল না। হৈমন্তীর এই হাসিকে অপু বিধাতার দান বলে মনে করেছে। গল্পজুড়ে তার স্নিগ্ধ হাসির মায়াজালেই অপু আচ্ছন্ন ছিল।
শ্বশুরবাড়ির অমানুষিক নির্যাতন ও রূঢ় নির্মম নিষ্ঠুরতায় হৈমন্তীর দেহমন শুকিয়ে জর্জরিত হয়েছে। এমনকি অপুর সংশয় ও উৎকণ্ঠার মুখে হৈম তার নির্মল শুভ্র হাসির অন্তরালে ঢেকে দিয়েছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত যন্ত্রণাক্লিষ্ট হৃদয়ের ক্ষতকে। হৈমন্তীর এই হাসি আরো তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল যখন অসুস্থ হৈমকে তার বাবা দেখতে আসেন এবং হৈমকে নিজের কাছে নিতে চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হন। এমন নির্মম আচরণের মর্মপীড়ায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েও বিদায়ের সময় বাপ-মেয়ে দুজনেরই মুখে হাসি। কন্যা হাসিতে হাসিতেই ভৎর্সনা করিয়া বলিল, 'বাবা তুমি যদি এ বাড়িতে আবারও আস, তবে ঘরে কপাট দেব।' বাবাও হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, 'ফের যদি আসি তবে সিঁধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব।' বাপ-মেয়ের এই হাস্যোজ্জ্বল বিদায়ের পরে হৈমন্তীর মুখের 'চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও' দেখা যায়নি। বস্তুত এখানেই গল্পের ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি ঘটে। অপু নিজেও বলেছে যে 'তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর বলিতে পারিব না'। অপু না বললেও হৈমন্তীর ইঙ্গিতপূর্ণ করুণ পরিণতি পাঠক স্বতই অনুভব করতে পারে; যা ছোটগল্পের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আর এই ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন অপু বলে, 'শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো এক দিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ_থাক্ আর কাজ কী!' এভাবে পাঠকের মনে অসম্পূর্ণতার অতৃপ্তি রেখে গল্প শেষ হয়ে যায়; যা ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যকে সমুজ্জ্বল করেছে। উপযুক্ত যৌক্তিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথাটি দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে ছোটগল্প রূপায়ণে উদ্দীপকের উক্তিটি শতভাগ প্রযোজ্য এবং সার্থক।
ঘ) উদ্দীপকে ছোটগল্পের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে নির্দেশিত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ নিরূপণে আমরা উদ্দীপকের উদ্ধৃত উক্তিটিকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথের 'হৈমন্তী' একটি অনবদ্য ছোটগল্প। উদ্দীপকে নির্দেশিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বোঝা যায় যে ছোটগল্পের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে 'হৈমন্তী' গল্পটির আবেদন সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ হয়েছে।
উদ্দীপকে বলা হয়েছে যে ছোটগল্পে পূর্ণাবয়ব জীবনের প্রকাশ থাকে না বরং জীবনের খণ্ডাংশ রস-নিবিড় হয়ে ফুটে ওঠে। ছোটগল্পের এই বিশেষ লক্ষণটি 'হৈমন্তী' গল্পের নায়িকার জীবনের করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
'হৈমন্তী' সাধারণ এক পারিবারিক পরিমণ্ডলে অঙ্কিত_স্বভাবকোমল পবিত্র মাধুর্যময় লাবণ্যময়ী এক মেয়ের কাহিনী; যে যৌতুক প্রথার যূপকাষ্ঠে হয়েছে নির্মম বলি। হৃদয়হীন স্বার্থান্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির নিষ্ঠুর আচরণে আর তার স্বামীর নিশ্চেষ্ট অসহায়তার মুখে সরল শুভ্র হৈমন্তী কিভাবে বলি হয়েছিল, গল্পের বাস্তব পটভূমিকায় লেখক সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি ও অপূর্ব মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তারই চমকপ্রদ ছবি এঁকেছেন। গল্পের নায়িকা হৈমন্তী যৌতুক প্রথার যূপকাষ্ঠে নির্মম বলি হলেও গল্পের কোথাও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে কিংবা সমাজ সংশোধনের সপক্ষে কোনো তত্ত্বকথা বা উপদেশ দেওয়া হয়নি। যা উদ্দীপকে নির্দেশিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যকে মেনে চলেছে। আবার ছোটগল্পে স্বল্পসংখ্যক চরিত্র ও সুনির্বাচিত ঘটনার সাহায্যে গল্পের ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতি দানই লেখকের উদ্দেশ্য হবে। 'হৈমন্তী' গল্পে অপু ও হৈমন্তীর বিয়ের উদ্যোগ ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে গল্পটি শুরু হয়েছে। তারপর থেকে ঘটনা লক্ষ্যভেদী তীরের মতো অব্যর্থ পরিণামের অভিমুখী হয়ে, সেই বিয়ের পরিণতি কী হয়েছিল ইঙ্গিতের মধ্য দিয়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আর এই হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী ঘটনাটি গল্পের নায়ক অপু নিজেই উপস্থাপন করেছে। ফলে 'হৈমন্তী' ছোটগল্প হিসেবে তার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে পেরেছে।
'হৈমন্তী' গল্পটি শেষ হয়েছে হঠাৎ পাঠকের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। 'শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো এক দিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ_থাক্ আর কাজ কী!' এভাবে পাঠকের মনে কৌতূহলের উদ্রেক করে কাহিনীর ইতি টানা হলেও পাঠককে তারপর অবশ্যই ভাবতে বসতে হয়। যা ছোটগল্প হিসেবে 'হৈমন্তী'-কে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। উপযুক্ত যৌক্তিক আলোচনায় উদ্দীপকে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ ও গঠনবৈশিষ্ট্য প্রয়োগে বলা যায়, 'হৈমন্তী' বাংলা সাহিত্যে একটি শিল্পসার্থক ছোটগল্প এবং এটি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃজন কীর্তির একটি অসামান্য স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।
No comments:
Post a Comment