শিশুর স্কুল ভীতি
ভোরের কাঁচা সর্য পূর্বাকাশে উঁকি
দিচ্ছে, জানালার ফাঁক গলিয়ে সরু আলোক রেখা ঢুকছে রুমে। মা ডাকছে, উঠতে হবে,
স্কুলে যেতে হবে, চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না, তবুও চোখ মেলে তাকাল সজীব। উহ
‘স্কুলের কথা মনে হলেই যেন শরীর অবশ হয়ে আসে, ঝিঁঝিঁ করে মাথা, ঝিনঝিন
অবসন্নতা যেন চেপে ধরে চলনশক্তি
ভোরের কাঁচা সর্য পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে, জানালার ফাঁক গলিয়ে সরু আলোক
রেখা ঢুকছে রুমে। মা ডাকছে, উঠতে হবে, স্কুলে যেতে হবে, চোখ খুলতে ইচ্ছা
করছে না, তবুও চোখ মেলে তাকাল সজীব। উহ ‘স্কুলের কথা মনে হলেই যেন শরীর অবশ
হয়ে আসে, ঝিঁঝিঁ করে মাথা, ঝিনঝিন অবসন্নতা যেন চেপে ধরে চলনশক্তি। হঠাৎ
করেই শুরু হয়েছে সমস্যাটি-স্কুলের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে, যেন স্কুল
থেকে দরে থাকতে পারলেই রক্ষা, স্কুলে যাওয়ার সময় যতই এগোতে থাকে, বুকের
ধরফড়ানিও বেড়ে যায়, বমি বমি লাগে, মাথা ঘুরায়, পেট ব্যথা কিংবা শরীরে
ম্যাজম্যাজ অনুভূতি জেগে ওঠে। মজার ব্যাপার হলো স্কুল বন্ধের দিন এসব
সমস্যা থাকে না।কখনো কখনো স্কুলে যেতে অস্বীকৃতি জানায় সজীব, বেঁকে বসে। কখনো রওনা হয় বাসা থেকে, স্কুলে পৌঁছার আগেই ফিরে আসে, আবার কখনো হয়ত স্কুলে গিয়ে হাজির হয়েছে, কিছুক্ষণ পরই চলে এল বাসায়। জোর করলেই নানা অজুহাত দেখাবে সে-কখনো বাসা থেকে বেরুতেই ভয়ের কথা বলবে, কখনো বলবে পথ চলার ভীতির কথা, অথবা স্কুলের নানা ভয়ের ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে সজীব। তাই জোরাজুরি করলেই ক্ষেপে ক্ষেপে উঠবে, হয়ত কান্না শুরু করে দেবে, অথবা শারীরিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, অনড় প্রতিরোধ। নিত্যই ঘটছে এমন, তবে স্কুলে না যাওয়ার কথা গোপন রাখে না সে, মা-বাবাও নিশ্চিত স্কুলে না গেলেও আশপাশে নিরাপদ কোথাও আছে সজীব।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে স্কুলে যাওয়ার অনীহা কোনো মানসিক রোগ নয়, বলা যায় এটি এক ধরনের আচরণ যার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে অনেক কারণ।
বয়সের কয়েকটি স্তরে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা জাগতে পারে। ৫-৭ বছরঃ স্কুল জীবনের শুরু থেকে। ১১ বা প্রায়ই এগারো বছরঃ যখন একটি শিশু প্রাইমারী থেকে সেকেন্ডারি স্কুলে প্রবেশ করে। টিনএজের শুরু ১৪ বছর থেকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সের বাচ্চাদের সাধারণত হঠাৎ করেই শুরু হতে পারে সমস্যাটি। বয়োসন্ধিক্ষণে শুরু হয় ধীরে ধীরে বন্ধুদের সাথে মেলামেশা, খেলাধুলা, হৈ চৈ কমিয়ে দেবে ছেলে বা মেয়েটি। পূর্বে এমনটি ছিল না সে, বরঞ্চ আনন্দপূর্ণ আচরণই ছিল তার চরিত্রের মলধারা।
সাধারণত শিক্ষকের পরিবর্তন, বাড়ি বদল, বন্ধু হারানো কিংবা শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি ঘটনাগুলো সমস্যাটি উসকে দিতে পারে। দীর্ঘদিন ছুটির কারণে স্কুলে যাওয়া হয় না, অথবা শারীরিক অসুস্থতার কারণেও অনেক সময় লম্বা লম্বা সময় অনুপস্থিত থাকতে হয়-এমনকি পরিস্থিতিতে স্কুল যাওয়ার দিনই অনীহা জাগতে পারে, অথবা আগে ছিল এমন সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
দাদা-দাদীর সাথে একটি শিশুর নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠে। অনেক সময় দেখা যায়, এদের কারও অসুস্থতা থাকলে শিশুটি স্কুলে যেতে চাইবে না। এমনও হতে পারে কোনো কোনো মা ইচ্ছাকৃতভাবেই সন্তানটিকে স্কুলে না যাওয়ার ব্যাপারে ইন্ধন দিয়ে থাকেন নিজের অজান্তেই, হয়ত বা অবচেতনভাবেই শিশুটির সান্নিধ্য কামনা করেন ভেতরে ভেতরে, অথবা ভাবেন স্কুলে যাওয়াটি অর্থহীন, কিংবা শিশুটি দরে থাকুক মানতে পারেন না।
অপেক্ষাকৃত কম বয়সের শিশুর স্কুলে না যাওয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকে সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার। যেমনটি ঘটেছে সজীবের ক্ষেত্রে। মাত্র ৮ বছর বয়স ওর। বাবার সাথে আছে নিবিড় বন্ধন। বাবা সরকারি কর্মকর্তা, বদলি হয়েছেন কক্সবাজার। বাবা চলে যাওয়ার পরই সজীবের ভেতরে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা শুরু হয়ে গেছে, অথচ এমনটি আগে কখনো ছিল না।
বয়স্ক শিশুদের স্কুলে যেতে না চাওয়ার কারণগুলো হলো- স্কুল ফোবিয়া বা স্কুল ভীতি, যাওয়া-আসার পথের সমস্যা, অন্য দুরন্ত শিশুদের দ্বারা অত্যাচারিত, পীড়িত বা সমালোচিত হওয়া, আশানুরূপ ফলাফলে ব্যর্থতা। টিনএজারদের স্কুলে না যাওয়ার সাথে জড়িত থাকে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন। স্কুলের প্রতি অনীহার সাথে সাইকোসিস বা বড় ধরনের মানসিক রোগের সংশিস্নষ্টতা তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
স্কুল পালানো শিশু আর স্কুলে যেতে চায় না এমন একটি শিশুর মাঝে রয়েছে সুসপষ্ট সীমারেখা। পালানো শিশুর মা-বাবা জানে না যে সন্তান স্কুলে যায়নি; স্কুলে যাওয়ার নাম করে বের হবে সে, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াবে, সিনেমায় যাবে, বাজে ছেলেদের সাথে আড্ডা দেবে, ছুটির সময় হলে বাসায় ফিরে আসবে অথবা ফিরতে দেরি করবে। এসব শিশুর পরীক্ষার ফলাফল খারাপ তার কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারই অন্তর্নিহিত মল কারণ। পারিবারিক সমস্যা যেমন-মা-বাবার দাম্পত্য কলহ-দুষকর্ম, বড় পরিবার, আর্থিক অনটন, দেখা শোনার নিয়মানুবর্তিতার অভাব স্কুল পালানো মনোভাব গড়ে তুলতে পারে একটি শিশুর ভেতর এর চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্নতর।
পক্ষান্তরে স্কুলে যেতে চায় না এমন শিশুর পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়ে থাকে-সমস্যাটির সাথে জড়িত থাকে পারিবারিক বৈশিষ্ট্য, ইমোশনাল ডিসঅর্ডার।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
১. দ্রুত স্কুলে ফেরত পাঠাতে হবে শিশুটিকেঃ হঠাৎ করে শুরু হওয়া সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হওয়ার আগেই এই ব্যবস্থা নিতে হবে, পুরো স্কুল পিরিয়ডই শিশুটিকে স্কুলে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মা ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে তাকে স্কুলে পাঠাতে পারলে ভালো ফল দেবে, শিশুটির মঙ্গলের জন্যই দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। মা-বাবাকে এক্ষেত্রে ছাড় দেয়া যাবে না। মা-বাবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং শিক্ষকের সমর্থন, সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টিচারের উচিত হবে স্কুলে পড়া ধরা কিংবা বাড়ির কাজ থেকে কিছুদিনের জন্য ছাত্র বা ছাত্রীটিকে রেহাই দেয়া, মমতা দিয়ে ধীরে ধীরে স্কুলের নিয়ম-শৃখলার সাথে তাকে একাত্ম করে নিতে হবে। স্কুলে অন্য ছাত্র-ছাত্রীর দ্বারা নাজেহাল হওয়ার ঘটনা থাকলে, উদঘাটন করতে হবে-ব্যবস্থা নিতে হবে শিক্ষককে। যাওয়া-আসার পথে কোনো সমস্যা আছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।
২. যদি সমস্যাটি ইতিমধ্যেই দীর্ঘায়িত হয়ে যায়, ধীরে ধীরে স্কুলের প্রতি সন্তানকে আগ্রহী করে তুলতে হবেঃ প্রথম প্রথম স্কুল থেকে ঘুরিয়ে আনতে হবে, ক্রমান্ব্বয়ে একটা ঘন্টা... দুই ঘন্টা... তিন ঘন্টা... এভাবে স্কুলে অবস্থানের সময় বাড়াতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষ একই ক্লাসের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে টিউটোরিয়াল ক্লাসের আয়োজন করে সমস্যায় আক্রান্ত শিশুটির অনীহা কমিয়ে আনা যায়, স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব।
স্কুল বদলানোর প্রয়োজন হতে পারে অনেক সময়। এ্যাংজাইটি তীব্রতর হলে হাসপাতালেও ভর্তির প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তবে এমন ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা কমই থাকে।
৩. পারিবারিক থেরাপিঃ শিশুর প্রতিটি কাজে, গতিবিধিতে মা-বাবার ভূমিকা কমিয়ে আনতে হবে। সন্তানের এই অনীহাকে কোনো অজুহাতেই ছাড় দেয়া যাবে না, সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে স্কুলে ফেরার ব্যাপারে এক্ষেত্রে বাবা-মার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফলাফল
দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে সফলতা আসে
যদি শিশুটির বয়স থাকে কম, সমস্যাটি যদি হঠাৎই শুরু হয়ে থাকে, সমাধানের পদক্ষেপ যদিও নেয়া দ্রুত ফলাফল আশাব্যঞ্জক। স্কুলে ফেরানো গেলেও আবেগীয় ও সম্পর্কজনিত সমস্যা সাধারণত থেকেই যায়, অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্ক সীমাবদ্ধতায় আটকে যায়, এক তৃতীয়াংশ নিউরোটিক ডিসঅর্ডারে ভুগে থাকে। খুবই কম সংখ্যকের মধ্যে বাইরে যাওয়ার ভীতি কিংবা কাজ করার অনীহা জাগতে পারে।
No comments:
Post a Comment