Saturday, August 4, 2012

ডেঙ্গুঃ কারণ ও প্রতিকার

ডেঙ্গুঃ কারণ ও প্রতিকার



ডেঙ্গুজ্বর : বিভ্রান্তিও করণীয়
বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব অনেক আগে থেকে। প্রায় প্রতি বর্ষাতেই কমবেশি ডেঙ্গু হয়ে থাকে। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষভাগে হঠাৎ ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেলে তা সবার নজরে আসে। মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা, আর দ্রুত কিছু মৃত্যু সাধারণ জনগণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ডেঙ্গু বলতে অনেকেই নিশ্চিত মৃত্যু মনে করতে থাকেন। ডেঙ্গু হয় রক্ত এবং প্লেটলেট দেয়া নিয়ে দৌড়াদৌড়ি আর অ্যান্টিবডি পরীক্ষার হিড়িক। অবশ্য গত দশ-বারো বছরে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। একদিকে চিকিৎসকদের যেমন অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার দক্ষতা বেড়েছে, তেমনি রোগী এবং জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডেঙ্গুজ্ব্বর নিয়ে ভীতিকর অবস্থারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় রক্তসঞ্চালন এবং প্লেটলেটের ব্যবহার কমেছে অনেক, সেই সাথে মৃত্যুর হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তবে জনমনে কিছুটা আতঙ্ক এবং ভুল ধারণা এখনো রয়ে গেছে, যা দূর করা দরকার।
ডেঙ্গুজ্বরে কি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে?
অনেকে এখনো মনে করেন যে, ডেঙ্গুজ্বর মানেই খুব মারাত্মক রোগ এবং এতে প্রায়ই রোগী মারা যায়। এই ধারণা একেবারেই ভুল। সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হলে সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রানত্ম প্রায় ১০০% রোগীই ভালো হয়ে যান। যদিও বলা হয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মৃত্যুহার ৫ থেকে ১০%, কিন' বাসত্মবে নিজ অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, এই হার ১%-এর নিচে। তাই ডেঙ্গু নিয়ে অযথা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
জ্বর কমে গেলে কি সব বিপদ কেটে গেল?
ডেঙ্গুতে জ্বর সাধারণত ৫ থেকে ৬ দিন থাকে এবং তারপর জ্বর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসতে পারে। জ্বর কমে গেলে বা ভালো হয়ে গেলে অনেক রোগী এমনকি অনেক ডাক্তারও মনে করেন যে, রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ডেঙ্গুজ্বরে মারাত্মক সমস্যা হওয়ার সময় আসলে এটাই। এ সময়  প্লেটলেট কাউন্ট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী কিছুদিনকে তাই বলা হয় ক্রিটিকাল পিরিয়ড। এ সময়েই সবার সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ডেঙ্গুজ্বরে ভোগার সময় কি অপারেশন করানো যাবে?
একেবারে অপরিহার্য না হলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় অপারেশন না করানোই ভালো, এতে সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রক্তপাত, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। অনেক সময় রোগীর পেটে ব্যথা হতে পারে যা অ্যাপেন্ডিসাইটিস বলে শনাক্ত করে জরুরি অপারেশন করা হয়। কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে এ সময় এই অপারেশন না করাই ভালো।
মা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে কি?
ডেঙ্গুজ্বর ভাইরাসবাহিত, মশার কামড়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। মায়ের বুকের দুধে এই ভাইরাস থাকে না। কাজেই, আক্রান্ত অবস্থায় মা বাচ্চাকে তার বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রানত্ম ব্যক্তির সাথে একত্রে থাকা যাবে কি?
ডেঙ্গু কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি রোগ নয়। কাজেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে এক বিছানায় শোয়া, একসাথে থাকা-খাওয়া বা রোগীর ব্যবহার্য কোনো জিনিস ব্যবহার করায় কোনো বাধা নেই।
ডেঙ্গুজ্বরে কী কী পরীক্ষা কখন করা উচিত? প্লেটলেট কাউন্ট এবং অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ভূমিকা কী?
জ্বরের শুরুতে বা দুই-এক দিনের জ্বরে রক্ত পরীক্ষায় কোনো কিছু শনাক্ত নাও হতে পারে এবং তা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করতে পারেন যে, রিপোর্ট ভালো আছে, তাই আর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে যে, প্লেটলেট কাউন্ট ৪ বা ৫ দিন পর হতে কমতে শুরু করে, তাই জ্বর শুরুর ৫ বা ৬ দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। এর আগে পরীক্ষা করলে তা স্বাভাবিক থাকে বিধায় রোগ নির্ণয়ে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় তেমনি অপ্রয়োজনে পয়সা নষ্ট হয়।
অনেকেই দিনে দুই-তিনবার করে প্লেটলেট কাউন্ট করে থাকেন। আসলে প্লেটলেট কাউন্ট ঘনঘন করার প্রয়োজন নেই, দিনে একবার করাই যথেষ্ট, এমনকি মারাত্মক ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারেও। তাছাড়া একই সাথে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লেটলেট কাউন্ট না করানোই ভালো, এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। দেখা যায় বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে বিভিন্ন রকমের রিপোর্ট আসছে, এতে কোন রিপোর্ট সঠিক তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তার বা রোগী বিভ্রান্তিতে পড়েন। তাছাড়া এতে অযথা রোগীর অর্থের অপচয় ঘটে।
আরও একটি পরীক্ষা অনেকেই করে থাকেন যেমন অ্যান্টি ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডি সাধারণত ৪ থেকে ৬ দিন পর তৈরি হয়। তাই এই সময়ের আগে এই পরীক্ষা করলে রক্তে অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় না, যা রোগ নির্ণয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। ডেঙ্গু অ্যান্টিবডির পরীক্ষা ৫ বা ৬ দিনের আগে করা উচিত নয়। মনে রাখা দরকার যে, এই পরীক্ষা রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করলেও রোগের চিকিৎসায় এর কোনো ভূমিকা নেই। এই পরীক্ষা না করলেও কোনো সমস্যা নেই, এতে শুধু শুধু অর্থের অপচয় হয়।
ডেঙ্গুজ্বরে আর কী কী পরীক্ষা করতে হবে?
সকল রোগীর ক্ষেত্রেই ব্লাড সুগার করা উচিত, ডেঙ্গুতে সাময়িকভাবে ব্লাড সুগার বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গুতে দুটি রুটিন পরীক্ষা করা হয় যা অপরিহার্য নয় এবং সকল ক্ষেত্রে করা হয় না, কিছু সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই করা উচিত। ডেঙ্গুতে সাধারণত লিভারের প্রদাহ (হেপাটাইটিস) হয়ে থাকে যার কারণে রক্তে লিভারের পরীক্ষাসমূহ স্বাভাবিক নাও হতে পারে। যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি বাড়তে পারে। তাই ডেঙ্গুজ্বর শনাক্ত হয়ে গেলে লিভারের জন্য এই পরীক্ষাগুলো বারবার করার কোনো দরকার নেই, রোগের চিকিৎসায়ও কোনো লাভ হয় না। এতেও অযথা অর্থের অপচয় ঘটে।
পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পেটে পানি (এসাইটিস) পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও রোগীর চিকিৎসার কোনো পরিবর্তন হবে না বা অতিরিক্ত কোনো ওষুধ দেয়া লাগে না। তাই রুটিন হিসেবে পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম করার কোনো দরকার নেই।
বুকের এক্স-রে করলে প্রায়ই বুকের ডান দিকে পানি পাওয়া যেতে পারে। যদি রোগীর শ্বাসকষ্ট থাকে তবে এক্স-রে করা যেতে পারে। তবে বুকে পানি জমলেও তা বের করার প্রয়োজন সাধারণত হয় না। ডেঙ্গুর চিকিৎসার উন্নতির সাথে সাথে তা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।
রক্তের বিটি ও সিটি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে চিকিৎসক যদি মনে করেন যে, রোগী ডিআইসি জাতীয় কমপ্লিকেশনে আক্রান্ত তবে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটিডি ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করতে পারেন।
যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত কারণে হয়, তাই রক্ত ও প্রস্রাবের কালচার রুটিন হিসাব করার প্রয়োজন নেই। তবে যদি ক্লিনিক্যালি অন্য কোনো সংক্রামক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবেই এই পরীক্ষা করা যেতে পারে। মাথার সিটি স্ক্যান সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, এমনকি প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকলেও।
চিকিৎসা বিষয়ে বিভ্রানিত্ম
ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত কারণে হয়, সেহেতু উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। যেমন জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ এবং এর সাথে প্রচুর পানি এবং শরবতজাতীয় তরল খাওয়ানোই যথেষ্ট।
রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ধরা পড়ার সাথে সাথে অনেক সময় রোগী এবং চিকিৎসক উভয়েই রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন যদি স্বাভাবিক থাকে তবে রক্ত পরিসঞ্চালন করার কোনো প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে রক্ত দিলে লাভ তো হবেই না, বরং অন্য কমপ্লিকেশন এমনকি হার্ট ফেইলিওরও হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, রক্তের প্লেটলেট কম হলেই অনেকে রক্ত দিয়ে বসেন। এতে কোনো লাভ হবে না। মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র কম প্লেটলেট কাউন্টের জন্য রক্ত দেয়া উচিত নয়।
প্লেটলেট কখন দেব, কখন দেব না?
ডেঙ্গুজ্বরের ৫ বা ৬ দিনে রোগের স্বাভাবিকতাতেই প্লেটলেট কাউন্ট কমতে থাকে, ২ বা ৩ দিন পর তা আপনাআপনি বাড়তে শুরু করে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই। অনেক সময় প্লেটলেট কাউন্ট অল্প কমে গেলেই রোগী ও চিকিৎসক খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং প্লেটলেট পরিসঞ্চালনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্লেটলেট পরিসঞ্চালনের কোনো প্রয়োজন হয় না। এক ইউনিট প্লেটলেটের জন্য চার ইউনিট রক্ত প্রয়োজন হয় এবং সেপারেটর দিয়ে আলাদা করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। অথচ রক্তে প্লেটলেটের হাফ লাইফ মাত্র ৬ ঘণ্টা। তাই প্লেটলেট পরিসঞ্চালনের সুফল হয় অতি স্বল্পমেয়াদি। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় এবং তাড়াহুড়ো করে প্লেটলেট দেয়ায় হেপাটাইটিস বি অথবা সি, এমনকি এইচআইভি দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বারবার প্লেটলেট দিলে রক্তে এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। তাই অপ্রয়োজনে প্লেটলেট দিলে লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হতে পারে। কাজেই প্লেটলেট দেয়ার জন্য রোগী এবং ডাক্তারের অযথা ব্যতিব্যস্ত হওয়ার বা চিন্তার কোনো কারণ নেই।
এছাড়া প্লেটলেট রিচড প্লাজমা (পিআরপি), প্লাজমা, ডেস্ট্রন ইত্যাদি কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই দেয়া যাবে, যেমন ডেঙ্গু শক সিনড্রম, ডিআইসি। অযথা এগুলো না দেয়াই ভালো।
অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া যাবে কি?
যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, এতে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা  নেই। তবে মনে রাখতে হবে যে, ডেঙ্গুর সাথে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগও থাকতে পার, যেমন টাইফয়েড ফিভার বা অন্য কোনো ইনফেকশন, যার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডাক্তার প্রয়োজন মনে করলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। অনেকে মনে করেন ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতি করতে পারে এবং তা পরিহার করতে হবে, যা একটি ভুল ধারণা। ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো ক্ষতি করবে না। তবে মাংসে ইনজেকশন দেয়া যাবে না।
ডেঙ্গুতে স্টেরয়েড ব্যবহার করা যাবে কি?
এ প্রসঙ্গটি বিতর্কিত, তবে সাধারণ মত হলো ব্যবহার করার বিপক্ষে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ডেঙ্গুর চিকিৎসায় যা মনে রাখা উচিত-
  • ডেঙ্গু কোনো মারাত্মক রোগ নয় এবং এতে চিন্তার কিছু নেই। রোগী ও রোগীর লোকদের অভয় দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  • ডেঙ্গুজ্বর নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়, এমনকি কোনো চিকিৎসা না করলেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে, যাতে কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়।
  • ডেঙ্গুরোগে কী কী করা দরকার তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কী কী করা যাবে না তা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। যা যা করা যায় তা প্রয়োজন অনুযায়ী করতে হবে, অতিরিক্ত করা যাবে না।
  • রক্ত বা প্লেটলেট পরিসঞ্চালন অপরিহার্য এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
ডেঙ্গু মশা এবং তার বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ-দুটোই আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। তাই ডেঙ্গুজ্বরকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। ডেঙ্গু আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ডেঙ্গুকে ভয় না পেয়ে ডেঙ্গুজ্বরের সাথে যুদ্ধ করেই এবং এর সাথে প্রতিরোধ করেই চলতে হবে।
লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
ডেঙ্গু : চাই সচেতনতা
ডা. জামশেদ রানা মামুন
শুরু হয়েছে ডেঙ্গু মৌসুম। ঢাকা শহরে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গুজ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই ভাইরাসের বাহক এডিস মশা।
ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ
শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে ১০৪-১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে, চোখের পেছনে, পেটে ব্যথা এবং হাড়ে বিশেষ করে মেরুদণ্ডে ব্যথা অনুভূত হয়। অরুচি, বমিবমি ভাব কিংবা বমি হতে পারে। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয় এবং পেটে ও ফুসফুসে পানি জমতে পারে। শরীরে হামের মতো দানা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ কমে যাওয়া, নাড়ির গতি দ্রুত হওয়া, ছটফট করা, শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট বা অজ্ঞান হয়ে পড়া-এসব লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
নিচের যে কোনো একটি উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ  নেবেন-
  • জ্বর হওয়ার ৩-৪ দিন পরও যদি জ্বর না কমে
  • যদি শরীরের চামড়ার নিচে লালচে ছোট ছোট দাগ বা র‌্যাশ দেখা দেয়
  • যদি চোখের কোণে রক্তের জমাট বাঁধা অবস্থা দেখা দেয়
  • যদি দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হয়
  • যদি বমি এবং পায়খানার সাথে রক্ত যায়
  • যদি প্রচণ্ড মাথাব্যথা, হাড়ে ব্যথা, চোখের কোটরে ব্যথা, মাংসপেশির খিঁচুনি দেখা দেয়
রোগীকে কখন হাসপাতালে নেবেন
যদি চোখের কোনায় রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থা দেখা দেয়, চামড়ার নিচে লালচে ছোট-ছোট দাগ বা র‌্যাশ দেখা দেয়, রক্তবমি বা রক্ত পায়খানা হলে, রক্তচাপ কমে গেলে কিংবা রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে সাথে সাথে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এছাড়া জ্বর যদি ৭ দিনের মধ্যে না কমে অথবা যদি রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু ধরা পড়ে, তাহলে আর এক মূহূর্তও দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডেঙ্গু নির্ণয়ে রক্তপরীক্ষা
সাধারণত জ্বর উচ্চতাপমাত্রায় (১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর বেশি) হলে, কয়েক দিন ধরে থাকলে এবং এর সাথে ডেঙ্গুর অন্যান্য প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা প্রথমেই করা দরকার, আর সেগুলো হলো (১) রক্তের প্লেটলেট কাউন্ট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা নির্ণয় (২) হেমোটোক্রিট বা প্যাকট সেল ভলিউম এবং (৩) রক্তের ব্লিডিং টাইম (বিটি), ক্লটিং টাইম (সিটি)। যদি রক্তে অণুচক্রিকা বা প্লেটলেটের সংখ্যা ১ লাখের কম হয় তবে ডেঙ্গুর ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। সাধারণত রক্তে অণুচক্রিকা বা  প্লেটলেটের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ পর্যন্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে ডেঙ্গুজ্বরের ভ্যালুও শতকরা ২০ ভাগ বেড়ে যায়।
ডেঙ্গুজ্বর হলে করণীয়
রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। দ্রুত জ্বর কমানো একান্ত জরুরি। এ জন্য মাথায় পানি দিতে হবে এবং ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছে দিতে হবে। প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। প্রথমেই জ্বর কমানোর চেষ্টা করতে হবে। রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি বা পানিজাতীয় খাবার খেতে দিতে হবে। এছাড়া স্বাভাবিক সব খাবার, বিশেষ করে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। সম্ভব হলে রোগীকে আক্রান্ত অবস্থায় মশারির মধ্যে বা নেট লাগানো ঘরের মধ্যে রাখতে হবে। ২-৩ দিনের মধ্যে জ্বর না কমলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যদি রোগী বমি করে, তাহলে প্রচুর পরিমাণে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। যদি রক্তক্ষরণের কোনো উপসর্গ দেখা দেয় তবে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। ডেঙ্গুর চিকিৎসার মূল কথা হচ্ছে  যেহেতু এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, এটি আপনাআপনিই সেরে যাবে। তবে ভাইরাস সেরে না যাওয়া পর্যন্ত যে কোনোভাবেই রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রোগীর দেহের অভ্যনত্মরীণ জলীয় পদার্থের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে এবং জ্বর সেরে যাওয়ার পরও রোগীকে ৩-৪ দিন পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
ডেঙ্গু হলে যা করা উচিত নয়
অযথা ভয় পাবেন না বা আতঙ্কিত হবেন না। মনে রাখবেন এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ আপনা-আপনিই সেরে যাবে। শরীরের তাপমাত্রা কখনোই ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি উঠতে দেয়া যাবে না। কোনো অবস্থাতেই রোগীকে অ্যাসপিরিন জাতীয় বেদনানাশক ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। শরীরের রক্তক্ষরণের কোনো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরি করা যাবে না। প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে দেরি করা যাবে না।
ডেঙ্গুজ্বরে চিকিৎসা কৌশল
ডা. খাজা নাজিম উদ্দিন
বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মৌসুমি জ্বর ডেঙ্গু শুরু হয়ে গেছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সারা বছর বৃষ্টি হয়, তাই ডেঙ্গুও সারা বছর হয়। আমাদের দেশে ডেঙ্গু হয় জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।
উপসর্গ
বৃষ্টির এ মৌসুমে যে কোনো জ্বরকে ডেঙ্গু ভেবে চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে। ডেঙ্গুর বিশেষ তিনটি উপসর্গ আমরা পাই-জ্বর, র‌্যাশ ও রক্তক্ষরণ।
জ্বর
সাধারণত প্রথমদিন থেকেই ভীষণ জ্বর ১০২০ ফারেনহাইটের সমান বা বেশি দিয়েই শুরু হয়। ভীষণ শরীর ব্যথা-এত ব্যথা যে অনেকে ডেঙ্গুকে হাড় ভাঙা ব্যথার জ্বর (ব্রেক বোন ডিজিজ) বলে। চোখের পেছনে ব্যথা (রেট্রেসরবিটার পেইন), ষষ্ঠ দিনে জ্বর নেমে যায়। দিন গোনা ঠিক থাকলে সাত দিনের বেশি জ্বর থাকলে সেটাকে ডেঙ্গু না ভাবাই ভালো। স্যাডল ব্যাক ফিভার (প্রথম ২ দিন জ্বর থাকল ১-২ দিন থাকল না আবার জ্বর এল) ডেঙ্গুর বৈশিষ্ট্য। এ রকম বিশেষত্ব ছাড়াও ডেঙ্গু হতে পারে, এমনকি জ্বর ছাড়াও ডেঙ্গু হতে পারে।
র‌্যাশ
জ্বরের ষষ্ঠ দিনে ডেঙ্গুর টিপিক্যাল র‌্যাশ বেরোয়। এর নাম কনভাল্যাসেন্ট কনফ্লুয়েন্ট পেটিকিয়াল র‌্যাশ। সারা শরীরে লাল দানায় ভরে যায়। মাঝেমধ্যে দানাবিহীন পরিষ্কার চামড়া দেখা যায়। দেখতে ভীতিপ্রদ হলেও এ র‌্যাশ আসা অর্থ অসুখ সেরে যাচ্ছে। জ্বরের সঙ্গে র‌্যাশ থাকলেই সেটা ডেঙ্গু নয়। জ্বরের দ্বিতীয় দিনে র‌্যাশ মানে স্কারলেট ফিভার। হামের র‌্যাশ আসে চতুর্থ দিনে। টাইফয়েডের র‌্যাশ সপ্তম দিনে। ডেঙ্গুর প্রথম দিকে মশার কামড়ের মতো ফ্লিটিং র‌্যাশ ও হাম বা জার্মান মিসলসের মতো সারা শরীরে লাল চাপ চাপ (ব্লিচি) র‌্যাশ হতে পারে। তবে কনভাল্যাসেন্ট কনফ্লুয়েন্ট পেটিকিয়াল র‌্যাশ হলে সেটা অবশ্যই ডেঙ্গু। জ্বরের প্রথম দিক থেকেই অনেকেই লাল (ফ্লাশড) হয়ে যায়। আঙুল দিয়ে চাপ দিলে বসে যায়
রক্তক্ষরণ (হেমোরেজ)
রক্তক্ষরণ ছাড়াও ডেঙ্গু ও ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হতে পারে। রক্তক্ষরণ (হেমোরেজ) হলেই সেটা সব ক্ষেত্রে ডেঙ্গু  হেমোরেজিক ফিভার নয়। শরীরের যে কোনো জায়গা থেকেই রক্তক্ষরণ হতে পারে। দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া, কফ, কাশি, থুথুর সঙ্গে রক্ত পড়া, চামড়ার নিচে, ইনজেকশনের জায়গায় রক্তক্ষরণ মারাত্মক নয়। মেয়েদের মাসিকের সময় রক্তক্ষরণই সবচেয়ে বেশি। এমনকি রেগুলার মাসিক হওয়ার পরও জ্বরের সময় দ্বিতীয়বার মাসিক হয়।
ডেঙ্গুকে হেমোরেজিক ফিভার না বলে এখন এটাকে লিকিং ডিজিজ বলে। রক্তনালির লিকেজের ফলে রক্ত, পানি ও রক্তের অন্য উপাদান রক্তনালির বাইরে চলে যায়। রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ কমা, পরুরাল ইফ্যুশন (ফুসফুসের থলিতে পানি জমা), এসাইটিস (পেটে পানি জমা) ও অন্য সব মারাত্মক সমস্যার জন্য আসলে লিকিংই দায়ী। ডেঙ্গু রোগী পরীক্ষা করলে পালস রেট কম পাওয়া যায় (রিলেটিভ ব্রাডিকার্ডিয়া)।
ডায়াগনোসিস
অন্যসব সংক্রামক রোগের মতো প্রাদুর্ভাবের সময় ডেঙ্গুকে সাসপেক্টেড, প্রোবাবল ও কনফার্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
সাসপেক্টেড
আমাদের দেশে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যে কোনো জ্বরকেই সাসপেক্টেড ডেঙ্গু হিসেবে আমরা চিকিৎসা শুরু করতে পারি। এখনো আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই। মেট্রোপলিটন শহরেই ডেঙ্গু হয়, ঢাকাতে ডেঙ্গু মারাত্মক হারে বেশি।
প্রোবাবল ডেঙ্গু
উপসর্গের সঙ্গে অ্যান্টিবডি টেস্ট পজিটিভ হলে।
কনফার্ম ডেঙ্গু
ভাইরাস আইসলেট করা গেলে। জ্বরের প্রথম ৪-৫ দিনে রক্তে ভাইরাস পাওয়া যায়। ডেঙ্গুকে তিনভাবে বর্ণনা করা হয়-
১. ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার
২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং
৩. ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম
১. ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার
অন্য জ্বরের মতোই উপসর্গ জ্বর র‌্যাশ থাকে, রক্তক্ষরণও থাকতে পারে।
২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার
ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভারের মতোই সব তবে এখানে লিকিংয়ের উপসর্গ থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী উপসর্গের সঙ্গে প্লেটলেট কাউন্ট ১ লাখের কম হলেও পিসিভি ২০ শতাংশ ভ্যারিয়েশন হলে সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (ডিএইচএফ) অন্যথায় নয়। এর সঙ্গে প্লাজমা লিকেজের বৈশিষ্ট্য (যেমন ইফ্যুশন, এসাইটিস, হাইপো অ্যালবুমিনিয়া ইত্যাদি) থাকে। তাই রক্তক্ষরণ না থাকলেও ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (ডিএইচএফ) হতে পারে। আর এ মৌসুমে প্লেটলেট কাউন্ট কম গেলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (ডিএইচএফ) আছে কি না যাচাই করে নেয়া ভালো।
স্টেজিং
ফেব্রাইল পিরিয়ড
প্রথম ৫-৬ দিন জ্বর থাকাকালীন। এফেব্রাইল পিরিয়ডের পরের ২-৩ দিন।
কনভালসেন্ট পিরিয়ড
এর পরের কয়েক দিন
ফেব্রাইল পিরিয়ডকে ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড বলে কারণ এ সময় লিকিং বা রক্তক্ষরণ হয়, প্রেসার কমে যায়, রোগী শকে গেলে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসক এবং রোগীকে তাই রক্তচাপ ও ফ্লুইডথেরাপি নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। তাই ডেঙ্গুতে জ্বর নেমে যাওয়া মানেই কিন্তু সেরে যাওয়া নয় বরং পরবর্তী ২ দিন সর্বাত্মক সতর্কতা নিতে হবে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার গ্রেডিং
গ্রেড-১ : জ্বর আছে ট্রর্নিকেট টেস্ট পজিটিভ কিন্তু রক্তক্ষরণ নেই
গ্রেড-২ : রক্তক্ষরণ আছে কিন্তু প্রেসার, পালস ঠিক আছে
গ্রেড-৩ : প্রেসার কম, পালস বেশি কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে
গ্রেড-৪ : প্রেসার, পালস কোনোটাই নেই
ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম
গ্রেড-৩ ও গ্রেড-৪ কে একত্রে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম বলে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষা
যে কোনো জ্বরের পরীক্ষা তৃতীয় দিনে শুরু করা ভালো। ফ্লু তিন দিনে সেরে যায়, স্কারলেট ফিভার তিন দিনেই ডায়াগনোসিস হয়ে যায়। ভাইরাল ফিভার ৭ দিনের বেশি থাকে না। জ্বর ৭ দিনের বেশি থাকলে তখন ব্যাক্টেরিয়াল ফিভার (টাইফয়েড ইত্যাদি) ভাবতে হয়। মৌসুমের সময় তাই আমাদের দেশে ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ভাইরাল ফিভার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, রিকেটশিয়া, লেপ্টোস্পাইরসিস ও ইদানীং সোয়াইন ফ্লু মনে রাখতে হবে।
রক্তের প্রাথমিক পরীক্ষা
সিবিসিঃ (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট)
টিসি ডিসিঃ ডেঙ্গুতে টিসি (স্বাভাবিক ৪-১১ হাজার) কমে। ২ হাজার বা ১.৫ হাজার হলে সেটা ডেঙ্গু ছাড়া কিছু নয়। অন্য ভাইরাল ফিভার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, রিকেটশিয়া টিসি স্বাভাবিক থাকে, কমলেও এত কমবে না।
হিমোগ্ল্লোবিনঃ ডেঙ্গুতে বাড়ে অন্য কোনো ইনফেকশনে এমনটা হয় না।
ইএসআরঃ ডেঙ্গুসহ সব ভাইরালে ইএসআর স্বাভাবিক থাকে অথবা কমে, টাইফয়েড বাড়ে।
পিসিভিঃ ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে বাড়ে। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গুতে স্বাভাবিক থাকে। পিসিভি (স্বাভাবিক ৩২ থেকে ৪২) বেশি ছিল, চিকিৎসা দেয়ার পর ২০ শতাংশ কমেছে অথবা রোগের জন্য ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে (একে বলে ২০ শতাংশ ভ্যারিয়েশন) দুটোই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ডায়াগনোসিসের জন্য জরুরি। প্লেটলেট কাউন্ট (স্বাভাবিক ১.৫ থেকে ৪.৫ লাখ)। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ১ লাখের নিচে নামবে। অনেকের ১০ হাজারের নিচে নেমে যায়। (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারাত্মক কিছু হয় না)। অন্য ভাইরাল ফিভার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, রিকেটশিয়া, লেপ্টোস্পাইরসিসে দেড় লাখের কম হয়, তবে জটিলতা না হলে ১ লাখের কম হয় না। লেপ্টোস্পাইরসিসে টিসি অনেক বাড়ে, প্লেটলেট কমে বৃষ্টির দিনে মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে নর্দমার পানি ও বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যায়। আমাদের অনেককেই এ সময় খালি পায়ে এ পানির মধ্যে হাঁটতে হয়। নর্দমার পানির সংস্পর্শে আসার জন্য এ মৌসুমে তাই লেপ্টোস্পাইরসিসও হয়।
অন্যান্য পরীক্ষা
সব জ্বরের জন্যই আমাদের দেশে প্রথম সপ্তাহে ব্লাড কালচার ও ম্যালেরিয়ার টেস্ট করা দরকার।
অ্যান্টিবডি টেস্ট
দ্বিতীয় সপ্তাহে করা উচিত। ডায়াগনোসিসের জন্য আইজিএম/অ্যান্টি ডেঙ্গু পজিটিভ হওয়া বেশি দরকার, আইজিজি অ্যান্টি ডেঙ্গু সাম্প্রতিক (রিসেন্ট) ইনফেকশন বোঝায় না। লিভার ফাংশন টেস্ট ডেঙ্গুতে এসজিওটি এসজিপিটির চেয়ে বেশি বাড়ে। প্লুরাল ইফ্যুশন (ফুসফুসের থলিতে পানি জমা), এসাইটিস দেখার জন্য বুকের এক্স-রে ও পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা যায়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রতারণা (ডিসেপশন)
হুবহু হার্টঅ্যাটাকের মতো ইসিজি হতে পারে, এমন ঘটনাও আছে যে রোগীর অ্যানিজওপ্লাস্টি করার সময় ধরা পড়েছে যে এটা ডেঙ্গু ছিল। এ মৌসুমে হার্টের রোগীর ইন্টারভেনশনের আগে, যে কোনো অপারেশনের আগে প্লেটলেট কাউন্ট কম থাকলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (ডিএইচএফ) আছে কি না দেখে নেয়া ভালো।
ডেঙ্গুতে রক্তের সুগার
জ্বরের সময় রক্তের গ্লুকোজ ১৭-১৮ মি.ম. হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার ডায়াবেটিস থাকেনি।
অন্যান্য
জটিলতা ছাড়াই রক্তের ক্যালসিয়াম কমে যেতে পারে, অ্যামাইলেজ, লাইপেজ বাড়তে পারে। প্রস্রাবে সুগার, প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে।
চিকিৎসা
উপসর্গভিত্তিক জ্বর
প্যারাসিটামল দিনে ৬০-৮০ মিলিগ্রাম/কেজি ৬ ঘণ্টা অন্তর (৪ ডোজে ভাগ করে)। তারপরেও ১০২-এর বেশি থাকলে আরও ৫০০ বা ১০০০ মিলিগ্রাম। জ্বর ৯৮-এ না এসে ১০১-এর নিচে থাকলেই যথেষ্ট। কোনোমতেই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ নয়। অনেকে ইনডোমেথাসিন, ডাইক্লফেনাক সাপজিটরি দেন, এগুলোতে রক্তক্ষরণ বাড়ায়, শকে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। প্যারাসিটামল সাপজিটরিতে ক্ষতি নেই। নিয়মিত স্পানিং গোসল, এসি ছেড়ে থাকলে, স্বল্পতম কাপড়ে থাকলেও পরিমিত পানি পানে জ্বর নামে (প্যানিক না হলে এতেই চলে)।
পানি
২ থেকে ২.৫ লিটার পানি পান নিশ্চিত করতে হবে। এটাই ডেঙ্গুর আসল চিকিৎসা। না খেতে পারলে স্যালাইন দিতে হবে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার গ্রেড-১ ও ডেঙ্গু ফিভারে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না, বাসায় চিকিৎসা করা যায়। জটিলতা না থাকলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার গ্রেড-২ও বাসায় চিকিৎসা সম্ভব। পেটের ব্যথা কমছেই না, আলকাতরার মতো কালো পায়খানা হচ্ছে, আবোল-তাবোল বলছে ইত্যাদি থাকলে হাসপাতালে যেতে হবে।
গ্রেড-৩ ও ৪ কে হাসপাতালে নিয়ে নরমাল স্যালাইন দিতে হয়। ৮ ড্রপ/মিনিটে শুরু করে বাড়াতে-কমাতে হবে, যাতে করে পালস-প্রেসার ২০ বা তার বেশি থাকে এবং সিস্টলিক প্রেসার ৯০-এর বেশি থাকে এবং প্রস্রাবের পরিমাণও (৫০-১০০ মিলি প্রতি ঘণ্টায়) স্বাভাবিক হয়। বেশি পানি দিলে (বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল পিরিয়ডে) ইফ্যুশন (ফুসফুসের থলিতে পানি জমা), এসাইটিস বেশি হবে, শ্বাসকষ্ট বাড়বে, সেরেব্রাল ইডিমা (ব্রেনে পানি জমবে)। সে জন্য ক্রিটিক্যাল পিরিয়ডে দক্ষ মনিটরিং দরকার। পিসিভি বা প্লেটলেট কাউন্ট দেখে ফ্লুইড অ্যাডজাস্ট করতে হয় না। ওগুলো করে ফলোআপ করতে হয়, জটিলতা নিরূপণ করা যায়।
ব্রডস্পেক্ট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক ফিলগ্রাস্টিম, করটিকস্টেরয়েড
যত লিওকোপিনিয়াই হোক ব্রডস্পেক্ট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক ফিলগ্রাস্টিম, করটিকস্টেরয়েড ইত্যাদি লাগে না। রক্তক্ষরণ বেশি হলে এবং ব্লাড প্রেসার কমলে পিসিভি কমলে রক্ত দিতে হবে। পিসিভি বেশি থাকলে মারাত্মক রক্তক্ষরণ থাকলে তবেই প্লেটলেট লাগবে নইলে নয়।
প্লেটলেট
প্লেটলেট জমাট বাঁধে বিধায় মেশিনে কাউন্ট করলে ভুল রিপোর্ট আসে, সে জন্য আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। ট্রান্সফিউশনেরও দরকার নেই। ডেঙ্গুর রক্তক্ষরণ শুধু প্লেট কমার জন্য হয় না। প্লেটলেটের অন্য অসুখেও কমে। ২০ হাজারের কম না হলে আপনা আপনি (স্পনটেনিয়াস) রক্তক্ষরণ হয় না।  প্লেটলেট কাউন্ট ১০ হাজারের কম না হলে ইন্টারনাল অর্গান (হার্ট, ব্রেইন) ইত্যাদিতে রক্তক্ষরণ হয় না। এক ইউনিট প্লেটলেট বানাতে ৪ জন ডোনার লাগে। ৪ জন থেকে নিয়ে দিলে কাউন্ট বাড়ে মাত্র ২০ হাজার, খরচ পড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা। তাই পার্লাটিলেট অর্ডার দেয়ার আগে দুবার ভাবা উচিত। প্যানিক না হলে আসলে প্লেটলেট লাগে না।
প্রতিরোধ
ডেঙ্গু ঠেকাতে হলে মশা ঠেকাতে হবে। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ফুলহাতা শার্ট পরতে পারেন, জঙ্গলে থাকে না তাই ঘরের মশা (গৃহপালিত মশা) মারতে হবে। মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে-এটা পাত্রমশা তাই কোনো পাত্রেই (জলকান্দা, টায়ার, চৌবাচ্চা) ৫ দিনের বেশি পানি জমতে দেয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত কার্যকরী ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি। অনেকেরই ধারণা ডেঙ্গু হলে এর জীবাণু বা প্রতিক্রিয়া শরীরে থেকে যায়। এটা অমূলক। জলবসন্ত যেমন একবার হলে আর জীবনে হয় না, ডেঙ্গু তেমনি একবার হলে দ্বিতীয়বার হওয়ার কথা নয়। পার্থক্য হলো ডেঙ্গুর ভাইরাস ৪টি। সে জন্য ডেন-১ দিয়ে হলে দ্বিতীয়বার ডেন-১ দিয়ে ডেঙ্গু হবে না, তবে ডেন-২, ডেন থ্রি বা ডেন-৪ দিয়ে ডেঙ্গু হবে। দুটি জিনিস মনে রাখার মতো যে কোনো স্ট্রেন (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ বা ডেন-৪) দিয়েই হোক না কেন ১২ মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হবে না। এরপর হলে অন্য স্ট্রেন দিয়ে হবে এবং সেটা হবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। অন্য লোকের ক্ষেত্রে যদি ১০০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে তবে একবার হলে দ্বিতীয়বার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫ শতাংশ।

No comments:

Post a Comment

Composition on Female Education in Bangladesh for Examination

  Female Education in Bangladesh Education is a light to which everybody has the equal right. Education is the backbone of a nation. The ...