ভয় মনের অবচেতন স্তরের একটি বিশেষ
মানসিক অবস্থা যাকে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আমরা সাধারণ বলতে পারি। এ
ভয়ের/ভীতির মাত্রা যখন স্বাভাবিকতা বা বাস্তবতাবর্জিত হয় তখনই তাকে আমরা
বলি ভয় রোগ/ভীতি রোগ/ভয় অসুখ ইত্যাদি। যেমন মনে করুন, একটি শিশু উচ্চস্তরের
শব্দ, আলোক, কখনো কখনো অন্ধকারকে ভয় পায়-একে আমরা সাধারণ ভয়/ভীতি বলতে
পারি। তবে যদি দেখা যায় এ শিশুটি তার কৈশোরে বা তারুণ্যেও উপরোল্লিখিত
অবস্থায় ভয় পায় তবে তাকে ভয় রোগ/ভীতি রোগ বলতে পারি।
পরীক্ষামেধার ক্রমবিকাশ, মূল্যায়ন, মানোন্নয়ন এবং স্বীকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যাপারটাই হচ্ছে পরীক্ষা। মেধার মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, চিন্তার গভীরতা, সৃজনশীলতা ইত্যাদিকে বিশ্লেষণের মানদণ্ডই হচ্ছে পরীক্ষা। একজন ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষাতে মূলত তার মানসিক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, মেধার বিকাশ ঘটায় এবং পরীক্ষাই তার মেধাকে স্বীকৃতি দান করে এবং সমাজের মাঝে তার একটা ইমেজ তৈরি করে।
ভয় অসুখ/ভীতি রোগ
মন ও মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভয় রোগের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া যায়। এটাকে আমরা এক ধরনের আতঙ্ক উদ্রেককারী মানসিক অবস্থা বলতে পারি। ভয় যখন এর সাধারণ ও বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে অস্বাভাবিক ও বাস্তবতাবর্জিত মানসিকরূপ ধারণ করে তখনই তাকে আমরা ভয় অসুখ/ভীতি রোগ বলি।
ভয় অসুখ বড় বিচিত্র, এটা স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে কয়েকটা অতি পরিচিত ভয় অসুখের মাঝে রয়েছে-একা থাকার ভয়, অন্ধকারে থাকার ভয়, কোনো নির্দিষ্ট প্রাণীকে ভয় (তেলাপোকা, টিকটিকি, সাপ ইত্যাদি), কোনো নির্দিষ্ট স্থানের প্রতি ভয়, অলৌকিক ও অতি প্রাকৃতিক ব্যাপারে ভয় ইত্যাদি।
ভয়ের উৎস শনাক্তকরণ
বিভিন্ন সময়ে মনোবিজ্ঞানীরা ভয়কে নানা দিক থেকে মনোবিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং উৎস সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন, যেমন-
(ক) বংশগত কারণ (জেনেটিক কারণ)।
(খ) মস্তিষেকর জৈবরাসায়নিক পরিবর্তনজনিত কারণ (নিউরোট্রান্সমিটারজনিত পরিবর্তন)।
(গ) শৈশব পর্যায় থেকে শিশুর মানসিক বিকাশে ত্রুটি, যেমন বিভিন্ন ধরনের অসুখী অভিজ্ঞতা, অভিভাবকের ভালোবাসা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার অভাব, সাহস ও শৃঙ্খলাবোধের অভাব ইত্যাদি।
(ঘ) ব্যক্তিত্বে ত্রুটিঃ আপনার ছেলেটি বা মেয়েটির শৈশব থেকেই কিছু ব্যক্তিত্ব ত্রুটি থাকতে পারে, যেমন অবসেশনাল বা হিস্টিরিক্যাল ব্যক্তিত্বের হলেও এ সমস্ত সমস্যা হতে পারে।
(ঙ) আর্থ-সামাজিক কারণঃ (অসুখী পরিবার) বারবার ঝগড়া, পরিবারের সদস্যদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ইত্যাদি।
(চ) বিভিন্ন প্রকার সামাজিক চাপঃ নানা প্রকার মনোসামাজিক চাপ, যেমন প্রিয় কাউকে হারানো, আর্থিক ক্ষতি, দারিদ্র্য, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, তীব্র প্রতিযোগিতা, সামাজিক অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে ভয় রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
(ছ) বিভিন্ন প্রকার আসক্তিকর ড্রাগঃ বারবিচুরেটস, অ্যামফিটামিন, গাঁজা, হেরোইন, মরফিন, পেথিডিন ইত্যাদি ড্রাগনির্ভরশীলতা গড়ে তুলতে পারে এবং পরবর্তীতে বাস্তবতার সমমুখীন হতে ভয়ের উদ্রেক করে।
(জ) ব্রেনের (মস্তিষ্কের) বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়কারক রোগঃ এছাড়া অন্যান্য কিছু গুরুতর মানসিক সমস্যা যেমন- সিজোফ্রেনিয়া, বিষণ্নতা ইত্যাদির সাথে সমন্বিত হয়ে ভয়ের উদ্রেক করতে পারে।
পরীক্ষাসম্পর্কীয় ভয় অসুখ/ভীতি রোগ
সাম্প্রতিককালে একটি উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত ভয়/ভীতি সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে যেটা বলতে হয় সেটি হচ্ছে পরীক্ষাসম্পর্কীয় ভয় অসুখ/ভীতি রোগ। পরীক্ষা সম্বন্ধে একটা সাধারণ ভয় বা চিন্তা মনে বিরাজ করতে পারে, যা পরীক্ষার জন্য দরকারি কিন্তু যখন এ ভয় তার স্বাভাবিক স্তর অতিক্রম করে অনেক দূর এগিয়ে যায় তখনই তাকে আমরা ভীতি অসুখ/ভয় রোগ/পরীক্ষা ভীতি বলতে পারি। মনে করুন, আপনার ছেলে বা মেয়েটি কোনোভাবে জানতে পারল তার পরীক্ষা অমুখ তারিখ থেকে শুরু হবে, সেই ভাবনার পর থেকে সে শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে বলল যে, তার বুক ধড়ফড় করছে, প্রচুর ঘাম হচ্ছে, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, বমি বমি লাগছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে ধরে নেবেন আপনার সন্তানটির সমস্যা শরীরে নয়, তার উৎস নিঃসন্দেহে মনে এবং এটাই হচ্ছে পরীক্ষা সম্বন্ধীয় অসুখ/ভীতি রোগ।
পরীক্ষাভীতির কারণে নিম্নলিখিত মনোশারীরিক উপসর্গ দেখা যায়
বমি বমি ভাব হওয়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বমি হয়ে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া করতে না পারা, বুক ধড়ফড় করা, মাথাব্যথা করা, মাথা ভার ভার লাগা, মাথা ঘুরানো, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘুম না আসা, বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যহীনতা, হঠাৎ করে হাত-পা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে আসা, ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়া, মূর্ছা যাওয়া, মনোযোগ দিতে না পারা, অল্পতে একাগ্রতা হারিয়ে ফেলা, স্মৃতিশক্তিতে সাময়িক ক্ষতি ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার ছেলে বা মেয়েটি যদি পরীক্ষার আগে এ ধরনের উপসর্গের শিকার হয়, তবে আপনার ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। কারণ মন ও মানসিক রোগবিজ্ঞানে এর খুব ভালো চিকিৎসা রয়েছে, যা শুধু আপনার সন্তানের এই অসুখটিই সারিয়ে তুলবে না বরং এটা তার মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তুলবে অনেক গুণে। অতএব, অবিলম্বে আপনার সন্তানটিকে নিয়ে মন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের (সাইকিয়াট্রিস্ট)-এর শরণাপন্ন হোন।
শিশু-কিশোরদের মানসিক অবকাঠামোর স্বরূপ এবং এর সাথে ভীতির সম্পর্ক
শিশু-কিশোররা মূলত অনুকরণ করতে তীব্র পছন্দ করে। স্বভাবত এবং সঙ্গত কারণে শিশুটির সবচেয়ে অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্বই তার বাবা-মা। অবশ্য পরিবার-পরিজন ও পারিপার্শ্বিকতাও তার ওপর প্রভাব ফেলে। শিশু-কিশোরদের মানবিক অবকাঠামো নিরূপণে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদি পরিবার পরিজনের বিভিন্ন সদস্যের মাঝে বিশ্বাসের ঘাটতি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও আদরের অভাব থাকে, শৃঙ্খলার চর্চা না থাকে তবে আপনার শিশুটি পরবর্তী জীবনে অনেক বড় বড় মানসিক সমস্যায় পড়তে পারে। এর একটি হচ্ছে পরীক্ষা সম্বন্ধীয় ভয় রোগ।
অন্য সমস্যাগুলো হচ্ছে
অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া এবং আরো অনেক সমস্যা, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া ইত্যাদি। কাজেই এগুলো দূরীকরণে পরিবার পরিজনদের মাঝে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আদর-ভালোবাসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি দিয়ে শিশুকে গড়ে তুলতে হবে।
এবার আসুন কীভাবে পরীক্ষাভীতি দূর করা যায় তা নিয়ে সামান্য মনোবিশ্লেষণ করি।
পড়াশোনার ধরন
নানা মুনির নানা মত। মানুষ মাত্রই মতের পার্থক্য হয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবু সামগ্রিক অর্থে মঙ্গলজনক চিন্তা করে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই ধরনের কথা উল্লেখ করা যায়-
(ক) লার্নিং গোল
(খ) পারফরমেন্স গোল।
লার্নিং গোল
এটা হচ্ছে পড়াশোনার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো টপিক্স সম্পর্কে পুরোপুরি তীক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে জানা এবং পরীক্ষাতে নিজের মতো করে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
পারফরমেন্স গোল
এটা হচ্ছে পরীক্ষাতে ভালো ফল লাভের একটা উপায়। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা সিলেকটিভ কিছু প্রশ্ন বেছে নেয় এবং সেই প্রশ্নগুলোর খুব সুন্দর উত্তর নিজেরা তৈরি করে বা টিউটরকে দিয়ে তৈরি করে নেয় এবং পরীক্ষাতে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরে। ফলে এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষাতে ভালো নম্বর পেলেও তাদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা কমে যায়। তাদের চিন্তা-চেতনার গভীরতা এবং মননশীলতা ও সৃজনশীলতাও কমে যায়। কেননা তাদের মূল লক্ষ্য থাকে পরীক্ষাতে ভালো করার দিক। কাজেই তাদের পড়াশোনা হয় মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক (এক্সাম ওরিয়েন্টেড)।
ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা এবং সফলতার সাথে ভীতির সম্পর্ক
ইচ্ছা, দক্ষতা, আকাঙ্ক্ষা এবং মানসিক চাপের মাঝে সুসপষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান। গবেষণা করে দেখা গেছে, একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ইচ্ছা পোষণ দক্ষতার মানকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। ইচ্ছার মাত্রা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে, অনাকাঙ্ক্ষিত সীমায় পৌঁছলে দক্ষতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ইচ্ছার মাত্রা যখন বাড়ে তখন দক্ষতার মাত্রা কেমন থাকে নিচের আলোচনাটুকু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে-
এটা গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত যে, ইচ্ছার মাত্রা যদি একটি মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে যেমন ৫০-৬৫% তখন দক্ষতার মাত্রা সবচেয়ে ভালো থাকে। এর নিচে বা ওপরে ইচ্ছার মাত্রা যতই হোক দক্ষতার মাত্রা ততই কম।
No comments:
Post a Comment