ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গের সঙ্গে ত্বকের
নিচে রক্তপাত, নাক অথবা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তপাত অথবা পাকস্থলী থেকে
রক্তপাত হলে তাকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বলা হয়। এসব রোগীর হাতে ব্লাডপ্রেসার
মাপার সময়, যদি প্রেসার বাড়িয়ে যন্ত্রটি পাঁচ মিনিট যথাস্থানে রেখে দেয়া হয়
তবে ত্বকের নিচে তাৎক্ষণিকভাবে ছোট ছোট রক্তপাত দৃশ্যমান হয়। এটি রোগ
শনাক্তকরণের একটি পদ্ধতি। একে বলা হয় পজিটিভ টরনিকুয়েট টেস্ট। এছাড়া ডেঙ্গু
হেমোরেজিক ফিভারে রক্তে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা এক লাখের নিচে
নেমে যায়। স্বাভাবিক একজন মানুষের রক্তে দেড় থেকে তিন লাখের মতো অণুচক্রিকা
থাকে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের আরেকটি জটিলতা হলো রক্তনালি থেকে রক্তের
জলীয় অংশ বা প্লাজমা টিস্যুতে বের হয়ে আসা। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে যেমন
বুক বা পেটে পানি জমে যেতে পারে। প্লাজমাস্বল্পতার জন্য রক্তের ঘনত্ব বেড়ে
যায়। রক্তকণিকার আপেক্ষিক ঘনত্ব বেড়ে যাওয়াকে বলা হয় হাই হিমাটোক্রিট।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে সাধারণত হিমাটোক্রিট স্বাভাবিকের চেয়ে ২০% বেড়ে
যায়।
ডেঙ্গু শক সিনড্রমডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে রোগীর যদি নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো থাকে তবে তাকে বলা হয় ডেঙ্গু শক সিনড্রম। এটি হলো ডেঙ্গু রোগীর সবচেয়ে ভয়াবহ লক্ষণ। যেসব উপসর্গ দেখলে বোঝা যায় রোগীর ডেঙ্গু শক বা অভিঘাত হয়েছে সেগুলো হলো-
১. অস্থিরতা
২. দ্রুত এবং দুর্বল নাড়ি গতি
৩. রক্তচাপের সিস্টোলিক ও ডায়াস্টলিক ব্লাডপ্রেসারের ব্যবধান যদি ২০ মিলিমিটার অব মারকারির চেয়ে কমে যায় (সাধারণত এ ব্যবধান ৪০ মিলিমিটার অব মারকারির মতো হয়ে থাকে)।
৪. হাত-পা যদি ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ডেঙ্গু রোগের তিনটি ধাপ রয়েছে এগুলো হলো-
১. ফেবরাইল বা জ্বরকালীন সময়-১-৭ দিন।
২. অ্যাফেবরাইল ফেইস বা জ্বর সেরে যাওয়ার অব্যাহতি সময় ২-৩ দিন।
৩. কনভালেসেন্ট ফেইস বা রোগ মুক্তিকাল ৭-১০ দিন।
এই তিনটি ধাপের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সময় হলো দ্বিতীয় ধাপ বা অ্যাফেবরাইল ফেইস। জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পর দু’তিন দিন এই স্তরটি স্থায়ী হয়। ডেঙ্গুজ্বরের প্রায় সব রকমের জটিলতা এই সময়টিতে শুরু এবং তা কখনো কখনো রোগীর মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারকে ৪টি গ্রেডে ভাগ করা হয়।
গ্রেড-১
এই পর্যায়ে রোগীর জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, চোখ ব্যথা এবং শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা এক লাখের নিচে নেমে যায়।
গ্রেড-২
গ্রেড ওয়ানের উপসর্গগুলোর সঙ্গে যদি রক্তপাত দৃশ্যমান হয় তবে তাকে বলা হয় গ্রেড টু ডেঙ্গুজ্বর।
গ্রেড-৩
এ পর্যায়ে রোগীর নাড়ির গতি চঞ্চল হয় এবং ব্লাডপ্রেসার কমে যায়।
গ্রেড-৪
এই চতুর্থ স্তরটিতে রোগীর প্রচণ্ড অভিঘাত দেখা দেয় এবং এ সময় ব্লাডপ্রেসার মেশিন দিয়ে রোগীর রক্তচাপ মাপা সম্ভব হয় না।
ডেঙ্গুজ্বর থেকে অন্যান্য জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম। তবুও যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে সেগুলো হলো-
১. রক্তপাত
২. অভিঘাত বা শক
৩. বুকে এবং পেটে পানি আসা
৪. হেপাটাইটিস বা যকৃতে প্রদাহ
৫. এনকেফালাইটিস বা মস্তিষেক প্রদাহ ও কোমা
৬. একিউট অ্যাবডোমেন বা পেটে প্রচণ্ড ব্যথা
ডেঙ্গু রোগীকে কখন হাসপাতালে নেবেন
সব ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার পড়ে না। বেশির ভাগ জ্বরই ডেঙ্গু ফিভার বা গ্রেড ওয়ান ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার পর্যায়ভুক্ত। যেসব কারণে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত সেগুলো হলো-
১. গ্রেড-২, ৩ ও ৪ হেমোরেজিক ফিভার
২. প্লাটিলেটের সংখ্যা যদি পঞ্চাশ হাজারের নিচে নেমে যায়
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
২. প্রচুর পানি খাওয়া
৩. জ্বরের জন্য শুধু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যাবে
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া জ্বর বা শরীর ব্যথার জন্য অন্য কোনো পেনকিলার বা জ্বরনাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু হলে ব্যথানাশক এনএসএআইডি জাতীয় ওষুধ যেমন ভলটারিন, ক্লোফেনাক, আলট্রাফেন, রিউমাসিড, নেপ্রোসিন, প্রোফেনিড, এনাফ্লেক্স জাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে না। জ্বর কিংবা শরীর ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন কিংবা অন্য ধরনের কোনো ব্যথার ওষুধ খেলে রক্তপাতের জটিলতা বেড়ে যায়। এতে সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরও শক সিনড্রমে মোড় নিতে পারে। তাই এসব ওষুধ এড়িয়ে চলতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর ২-৩ দিন পরপর প্লাটিলেট এবং হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা যেতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং শক সিনড্রমের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। প্রধান চিকিৎসা স্যালাইন দিয়ে রক্তের জলীয় অংশের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখা। দরকার হলে প্রতি ঘণ্টায় প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৬ মিলিলিটার পর্যন্ত ফ্লুয়িড বা স্যালাইন দেয়া যায়। তবে কতটা স্যালাইন দেয়া হবে তা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর এবং চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী।
ডেঙ্গু রোগীকে কখন প্লাটিলেট দেয়া হবে তার জন্য অনেক সময় রোগীর পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজন দুশ্চিন্তায় থাকে। প্লাটিলেট কিংবা অণুচক্রিকার সংখ্যা দশ হাজারের নিচে না নামলে সাধারণত প্লাটিলেটের দরকার পড়ে না। কিন্তু রোগীর যদি রক্তপাতের উপসর্গ থাকে তবে অণুচক্রিকার সংখ্যা দশ হাজারের বেশি থাকলেও প্লাটিলেট দেয়ার দরকার হতে পারে।
No comments:
Post a Comment