বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি
লাভের পর এমফিল গবেষণায় ভর্তি হয়েছে পারভীন পুষ্প। এ সময় একটি চাকরি তার
চাই-ই। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এসএসসি, এইচএসসি ছাড়াও মাস্টার্সে তার
ফার্স্ট ক্লাস রয়েছে। তারপরও পছন্দমতো চাকরি মিলছে না। সবদিক থেকে ফিট হওয়া
সত্ত্বেও ইন্টারভিউ বোর্ডে গিয়েই সব তালগোল পাকিয়ে যায় পুষ্পর। ডাক পাওয়ার
কিছুক্ষণ আগে প্রচণ্ডভাবে হার্টবিট বেড়ে যায়। এক মুহূর্তে ঘেমে একাকার। যা
প্রস্তুতি ছিল নিমিষেই সব শেষ। অতঃপর যথারীতি ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত
হয়ে তালগোল পাকিয়ে যায় তার। মনোকষ্ট নিয়ে কাটে পরবর্তী সময়গুলো।
সাক্ষাৎকারগুলো এমনিভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আজ অবধি চাকরি হয়নি তার। এ ঘটনা
শুধু পারভীন পুষ্পর নয়। তার মতো অনেকেই ইন্টারভিউ বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ
সময়ে নার্ভাস হয়ে পড়ে। ক্যারিয়ার গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিবেচনা করে
ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রার্থীর প্রস্তুতির নানা বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো।
উদ্বেগকে দূরে সরিয়ে রেখে ইন্টারভিউতে ভালো ফল করার জন্য ‘মানসিক দৃঢ়তা’
বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বিচলিত না হয়ে ধীর-স্থিরভাবে
ইন্টারভিউ দিতে হবে। ইন্টারভিউতে অকৃতকার্য হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে অত্যধিক
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ডাক পাওয়ার পর থেকেই অনেকেই নার্ভাস ফিল করতে থাকেন।
ইন্টারভিউ-এর দিন, বিশেষত ইন্টারভিউ দেয়ার ঠিক আগে এবং দেয়ার সময়ে অনেকে এত
ভয় পেয়ে যান যে, জানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। হাত-পা কাঁপতে থাকে,
গলা-ঠোঁট শুকিয়ে যায়, কথা অসপষ্ট হয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করে ইত্যাদি।ইন্টারভিউ দেয়ার আগে এবং ইন্টারভিউ দেয়ার সময় যারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগেন, ইন্টারভিউতে ভালো ফল করতে পারন না, তারা কীভাবে এর হাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন, সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হলো।
- যারা ভালো প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদে চাকরি করেন, যারা ইন্টারভিউ নিয়ে থাকেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করুন। এর ফলে ইন্টারভিউ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। মনের অনেক প্রশ্নেরও সমাধান হবে। মনটা শান্ত থাকবে।
- নিজের সম্পর্কে কখনো হীন ধারণা পোষণ করবেন না। হীনতাবোধ জীবনে অনেক ক্ষতি করে। নেতিবাচক কোনো চিন্তা মনে রাখবেন না। যেমন আপনি কৃতকার্য হবেন না, ইন্টারভিউতে যে সকল প্রশ্ন করা হবে সেগুলো ঠিকমতো উত্তর দিতে পারবেন না, আপনি ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না ইত্যাদি। সর্বদা ইতিবাচক কথা ভাবুন ও বলুন। যেমন আপনি কৃতকার্য হবেন, সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন, যে কজন প্রার্থী থাকবেন তাদের মধ্যে আপনিই সব থেকে ভালো ফল করবেন-কারণ, আপনি একজন যোগ্য প্রার্থী।
প্রতিদিন ‘রিলাক্সেশন’ বা পূর্ণ বিশ্রাম
নেয়ার অভ্যাস করুন। যে কোনোরকম উৎকণ্ঠার ‘স্ট্রেস’ থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ
উপায় হলো এটি অভ্যাস করা। প্রথম প্রথম দিনে দুবার ১৫-২০ মিনিট রিলাক্সেশন
অভ্যাস করুন। রিলাক্সেশন নানাভাবে করা যেতে পারে। এর অনেক পদ্ধতি আছে।
বাড়িতে বিছানায় বা সোফায় শুয়ে অথবা চেয়ারে বসে, এমনকি মেঝেতে শুয়েও অভ্যাস
করা যায়।
‘ইন্টারভিউ’ কথাটা শুনলেই কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব মনে জাগে-এ কথা
অনেকেই বলেও থাকেন। তাদের কাছে ইন্টারভিউয়ের অর্থ হলো টেবিলের ওপাশে গম্ভীর
মুখে বসে থাকা কিছু লোক টেবিলের এ পাশে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের প্রশ্নবাণে
জর্জরিত করে চলেছেন। প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে হয়। উত্তর শেষ
হওয়ার আগেই আর একজন প্রশ্ন করেন। কেউ কেউ ঠাট্টা বিদ্রূপ করেন। কেউ কেউ
আবার ধমক দেন ইত্যাদি। যারা ইন্টারভিউ দিয়ে সফল হননি তারা অনেক সময় অনেক
কথা প্রচার করে থাকেন। যারা ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তাদের ওই
সমস্ত প্রচারে কর্ণপাত না করাই ভালো। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ
নেয়ার সময়ে প্রার্থীকে নানাভাবে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু
বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ হয় খুবই সুপরিকল্পিতভাবে। বিভিন্ন বিষয়ের
বিশেষজ্ঞরা খুবই মার্জিতভাবে ইন্টারভিউয়ের কাজ পরিচালনা করেন। তাই বিনা
কারণে ইন্টারভিউ নিয়ে মনের মধ্যে কোনো ভয় পোষণ করা অর্থহীন। ইন্টারভিউ
দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে কী করতে হবে, ইন্টারভিউতে কী কী দেখা হয় ইত্যাদি
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা আপনারা শুনেছেন এবং অনেক সুপরিকল্পিত লেখাও
পড়েছেন। বর্তমান লেখাটিতে শুধু মানসিক ও আচরণগত বিষয় আলোচিত হলো।(১) যে কোনোভাবে একটি চাকরি পেতে হবে-এই মানসিকতা নিয়ে অনেকে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে প্রচুর সংখ্যায় দরখাস্ত করতে থাকেন। এটা করা ঠিক নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, দরখাস্তকারী ইন্টারভিউতে ডাক পান না। আবার দু-এক জায়গায় ডাক পেলেও চাকরি পান না। এতে মনে হতাশা জন্মায়। আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। যে ব্যক্তি যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং যিনি যে বিষয়ে পারদর্শী তার সেই বিষয় সম্পর্কিত কোনো কাজের জন্য দরখাস্ত করা উচিত।
(২) বিজ্ঞাপন দেখে ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা করে দরখাস্ত করার পর ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত। অনেকে ভাবেন ইন্টারভিউতে ডাক পেলে তবেই নিজেকে প্রস্তুত করবেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হলে নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করতে হবে এবং তা দরখাস্ত ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই।
(৩) ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়ার পর ছুটোছুটি করে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকে বলার প্রয়োজন নেই। অনেকের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায়। সকলকে জানানোর ফলে নিজের ওপর একটা বাড়তি চাপ এসে পড়ে।
(৪) ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়ার পর সব কাজ বন্ধ করে, খেলাধুলা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখাও উচিত নয়। এই প্রবণতাও অনেকের মধ্যে দেখা যায়। এতেও মনের ওপর চাপ পড়ে।
(৫) ইন্টারভিউকে জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে না ধরে স্বাভাবিক পরিণতি মনে করতে হবে। অনেকের মনে এই চিন্তা আসে ‘এই ইন্টারভিউতে একটা চাকরি পেতেই হবে, না হলে আমি একটা খারাপ কিছু করে বসব। ভবিষ্যতে আর কোনো ইন্টারভিউতে ডাক পাব না, চাকরিও পাব না ইত্যাদি। এই ধরনের চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়। এতে জীবনে হতাশা বাড়ে।
(৬) ইন্টারভিউ দিতে গেলে দামি জামা-কাপড় পরতে হবে-এই রকম চিন্তা কেউ কেউ পোষণ করেন। জামা-কাপড়ের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটি সম্পর্ক রয়েছে। যে ধরনের জামা-কাপড় পরলে প্রার্থীকে সুন্দর লাগে তেমনই পরা ভালো।
(৭) কেউ কেউ ভাবেন উষকশুষক চুলে অনেকটা হতাশা ও চিন্তায় জর্জরিত চেহারা নিয়ে গেলে সহজেই চাকরি পাওয়া যাবে বা এই রকম চেহারা দেখে এবং প্রার্থীর চাকরি পাওয়াটা কত জরুরি তা ভেবে নিয়োগকর্তা দয়াপরবশ হয়ে চাকরি দিয়ে দেবেন। এই ধরনের চিন্তা পোষণ করা একেবারেই উচিত নয়।
(৮) ইন্টারভিউতে স্মার্ট অথচ অমায়িক আচরণ করতে হবে। কোনোভাবেই আচরণে উষ্মা প্রদর্শন বা কোনোপ্রকার অভদ্রতা করা উচিত নয়। কোনো প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে তা অকপটে স্বীকার করে নেয়া উচিত। কোনোভাবেই নিজের অজ্ঞানতা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করবেন না।
(৯) ইন্টারভিউ দেয়ার সময় কোনো অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা একেবারেই চলবে না। নিজেকে বুদ্ধিমান ও কাজের যোগ্য হিসেবে প্রমাণিত করার জন্য যেটুকু বলা প্রয়োজন সেটুকুই বলবেন।
(১০) ইন্টারভিউয়ের ফলাফল কী হলো বা প্রার্থীকে কীভাবে তা জানানো হবে, তা জিজ্ঞাসা করা একেবারেই উচিত নয়। যখন আপনি রিলাক্সেশন করবেন সেই সময় মানসচক্ষে কয়েকটি পরিস্থিতি অবলোকন করুন বা কল্পনা করুন। যেমন-আপনি ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছেন, নিজেকে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য তৈরি করছেন, ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন, ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, নিয়োগকর্তা আপনাকে প্রশ্ন করছেন এবং আপনি সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। তবে মনে রাখবেন, একসঙ্গে একটির বেশি দৃশ্য কল্পনা করবেন না এবং এক একবারে ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের বেশি কল্পনা করবেন না। একটু সময় বাদ দিয়ে ছোট ছোট দৃশ্য কল্পনা করুন। এভাবে রিলাক্সেশনের মধ্যে দৃশ্যগুলো একে একে কল্পনা করলে আপনার মধ্যে উৎকণ্ঠা থাকবে না। কারণ রিলাক্সেশন ও উৎকণ্ঠা দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অনুভূতি। এই দুটি অনুভূতি একই সঙ্গে হতে পারে না। এভাবে বেশ কিছুদিন অভ্যাস করার পর যখন বাস্তবে ইন্টারভিউ দিতে যাবেন তখন স্বাভাবিক ও নিরুদ্বিগ্ন অবস্থায় ইন্টারভিউ দিয়ে আসতে পারবেন।
No comments:
Post a Comment