বিদেশী পত্রিকা অবলম্বনে
নানা রেডিওলজিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টের কল্যাণে রোগের যাবতীয় খুঁটিনাটি জানা আজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং অপ্রয়োজনে অনেক বেশি টেস্ট করাতে হচ্ছে কি? কোন অসুখে কি উপসর্গ দেখা গেলে, কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে জেনে নিন।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের প্রধান উপসর্গ পেটে ব্যথা। তলপেটের ডান দিকে ব্যথা করে। বাঁ দিকে চাপ দিলেও ব্যথা বাড়ে। বমি পায়, বারে বারে বমি হয়। খিদে কমে যায়, অল্প জ্বর থাকে। অবশ্য ইউরিনারি ইনফেকশন বা অন্য কারণেও এসব হতে পারে। তাই অ্যাপেন্ডিসাইটিস সন্দেহ হলে কয়েকটি পরীক্ষা করে নিতে হয়। যেমন আলট্রাসনোগ্রাফি, স্ট্রেট এক্স-রে, ইউরিনের রুটিন টেস্ট, রক্তে টিসি, ডিসি এবং সুগার।

ইএনটি
হাঁচি, কাশি, গলা ব্যথা, কানে ব্যথা হলে নিজে ওষুধ না খেয়ে ডাক্তার দেখান।

অ্যাডিনয়েড
অ্যাডিনয়েডের প্রদাহ হলে এটি আকারে বেড়ে যায়। ফলে নাক বন্ধ হয়ে যায়। নাক দিয়ে সর্দি ঝরে, কানে ব্যথা হয়, পুঁজ হয়, শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে। বারে বারে এটির সংক্রমণ হলে অপারেশন করাতে হয়। এর জন্য কিছু কিছু পরীক্ষা করতে হয়। যেমন ন্যাসো ফ্যারিংসের সফট টিস্যু এক্স-রে করাতে হয়। কানে ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছেন কি না তার জন্য অডিওগ্রাম ও টিমপ্যানোগ্রাম করাতে হয়। কানে পুঁজ থাকলে বা ব্যথা হলে কানের ম্যাসটয়েড বোনের এক্স-রে করাতে হয়।

টনসিলাইটিস
ব্যাক্টেরিয়া এবং ভাইরাস দু ধরনের জীবাণুর সংক্রমণের ফলে টনসিলের অসুখ করে। এটি বোঝার জন্য ক্লিনিক্যাল টেস্ট ছাড়া আরো কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। ভাইরাসের জন্য অ্যান্টিভাইরাল অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যেতে পারে। আর ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে থ্রোটসোয়াব টেস্ট করার পরামর্শ দেয়া হয়। এর সঙ্গে কোয়াগুলেজ টেস্টও করাতে হতে পারে। এছাড়া এএসও টাইটার, চেস্ট এক্স-রে, রুটিন ইউরিন টেস্টও করাতে হয়।

হার্টের অসুখ
বুকের বাঁ দিকে ব্যথা মানেই হার্টঅ্যাটাক নয়। যাদের হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত, একটু বেশি পরিশ্রম করলে তাদের প্রায়ই বুকে চাপা ব্যথা হয়। ব্যথাটা শুরু হয় বুকের ঠিক মাঝখান থেকে। মনে হয় বুকের ওপর কেউ ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। বুকে ব্যথা বা নিঃশ্বাসের কষ্ট হলে এবং বংশে হার্টের অসুখের ইতিহাস থাকলে কিছু কিছু পরীক্ষা করিয়ে নেয়া জরুরি। যেমন ইসিজি, ট্রেডমিল টেস্ট, করোনারি এনজিওগ্রাম, হল্টার মনিটর, চেস্ট এক্স-রে, রক্তের রুটিন টেস্ট ছাড়াও সুগার, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ভাইরাল এন্টিজেন স্ক্রিনিং, লিপিড প্রোফাইল। করোনারি আর্টারি ব্লক থাকলে হার্টএ্যাটাক রুখতে বাইপাস সার্জারি অথবা এনজিওপ্লাস্টি করা হয়। ইদানীং বিটিং হার্ট সার্জারি জনপ্রিয় হয়েছে।

থাইরয়েড
সাধারণত পুরুষদের চেয়ে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হন থাইরয়েডে। থাইরয়েডের অসুখকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। গয়টার বা গলগণ্ড, থাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপোথাইরয়েড বা থাইরোটক্সিকোসিস।

থাইরয়েডের অসুখ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে রক্তের টিথ্রি, টিফোর, টিএসএইচ, ফ্রি টিথ্রি, ফ্রি টিফোর পরীক্ষা করতে হয়। গয়টারে যদি সলিটারি নডিউল থাকে (শক্ত গ্ল্যান্ডের মতো) তবে এফএনএসি করাতে হয়। অনেক সময় থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের আলট্রাসনোগ্রাম স্ক্যান বা আইসোটোপিক স্ক্যান করাতে হয়। চোখ ঠেলে বেরিয়ে এলে চোখের অরবিটের সিটি স্ক্যান করতে হতে পারে।
দাঁত
দাঁতের বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন দন্তক্ষয়ের গভীরতা, দাঁতের অবস্থান, দুটি দাঁতের মধ্যবর্তী মাড়ির গভীরতা, দাঁতের শিকড়ের গোড়ায় কোনো সংক্রমণ, আক্কেল দাঁতের বিচ্যুতিগত অবস্থান ইত্যাদি নির্ণয়ের জন্য ইন্ট্রাওরাল পেরি এপিকাল এক্স-রে করা প্রয়োজন। দাঁতের একত্র অবস্থান, চোয়াল ভেঙে যাওয়া, চোয়ালের সন্ধির কোনো রোগ, বিচ্যুতি, আক্কেল দাঁতের অবস্থান, দাঁতের গোড়ায় কোনো সিস্ট বা টিউমার, চোয়ালের মধ্যে আটকে থাকা কোনো দাঁতের অবস্থান জানার জন্য অর্থোপ্যান্টোমাগ্রাম এক্স-রে করা প্রয়োজন। ল্যাটারাল অবলিক এক্স-রের মাধ্যমে যে কোনো একদিকের চোয়ালের অবস্থান ও সেই দিকের চোয়ালের সন্ধির কোনো বিচ্যুতি রোগ নির্ণয় করা যায়। অক্লুসাল এক্স-রের মাধ্যমে মূলত একটি চোয়ালের সবকটি দাঁতের বিষয়ে জানা যায়। সাধারণত চোয়ালের মধ্যে কোনো আটকে থাকা দাঁতের অবস্থান, দাঁতের গোড়ায় কোনো সংক্রমণ ইত্যাদি এই এক্স-রের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।

সাধারণ অসুখ-বিসুখ
নিউমোনিয়া
ফুসফুসের ইনফেকশনকে বলে নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়ার লক্ষণ শুরু হয় হঠাৎই। এ রোগের অন্যতম উপসর্গ জ্বর। ১০৪-৫০ জ্বর উঠে যায়। বাচ্চাদের কনভালসন বা তড়কার সম্ভাবনা থাকে। সঙ্গে বুকে ব্যথা, কাশি আর নিঃশ্বাসের কষ্ট। রোগ নির্ণয় করতে ফুসফুসের এক্স-রে ব্রঙ্কোস্কোপি, সপুটাম কালচার, রক্তের রুটিন টেস্ট করাতে হয়।

কিডনির অসুখ
কিডনির অসুখের কথা শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে আসে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের কথা। কিডনির অসুখের মধ্যে আছে-অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রম এবং রেনাল ফেলিওর।

অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস
বাচ্চা এবং যুবকদের মধ্যে এই অসুখের প্রবণতা বেশি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে চোখ আর মুখ ফুলতে দেখা যায়। প্রস্রাব কমে যায়, ফলে পা এবং হাতও ফুলতে থাকে।

রেনাল ফেলিওর
কোনো কারণে কিডনির কাজকর্ম ব্যাহত হলে তাকে বলা হয় রেনাল ফেলিওর। অ্যাকিউট এবং ক্রনিক দু ধরনের রেনাল ফেলিওর হতে পারে। রেনাল ফেলিওর হলে প্রস্রাবের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া অ্যানিমিয়া, হাইপ্রেসার, বমিবমি ভাব, খিদে কমে যাওয়া, বমি, শ্বাসকষ্ট হওয়া, মাথাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। কিডনির রোগ নির্ণয়ের জন্য ইউরিন টেস্ট, ব্লাডের ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন টেস্ট, পাইলোগ্রাফি, ইউএসজি, সিটি স্ক্যান, কিডনির বায়োপ্সি, রেনোগ্রাম, রেনাল এনজিওগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

চোখের অসুখ
আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয় চোখ। চোখের কোনো রকম সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

রেটিনার অসুখ
ক্যামেরার ফিল্মের মতো আমাদের চোখের শেষতম স্তর রেটিনা। রেটিনার একটু নিচে আছে ম্যাকিউলা। রেটিনা এবং ম্যাকিউলা এই দুইয়ের সমস্যাকে বলে রেটিনার অসুখ। রেটিনার অসুখকে অবহেলা করলে রোগ বাড়তে বাড়তে মারাত্মক হয়ে পড়ে এবং ম্যাকিউলার অসুখ নির্ণয় করতে হলে ডাক্তার প্রথমে অক্ষিগোলক ডায়লেট করে দেখেন। এছাড়া সপন্ডার্স ফ্লুরোসিন এনজিওগ্রাফি করতে হয়। রেটিনায় কোনো লিকেজ থাকলে লেজার ট্রিটমেন্ট করতে হয়।

গ্লকোমা
অ্যাকিউট গ্লকোমা হলে চোখে রামধনুর রং দেখা যায়, মাঝে মাঝে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যায়, চোখ ব্যথা করে, বমি বমি ভাব থাকে। গ্লকোমা সন্দেহ হলে চোখের যে পরীক্ষা করতে হয় তার নাম শিল্ডস।

ছানি
আমাদের দেশে যত দৃষ্টিহীন মানুষ আছেন তাদের বেশির ভাগই ছানিজনিত কারণে দেখতে পান না। ছানি হলে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে শুরু করে। ঘনঘন চশমা পাল্টেও কোনো লাভ হয় না। রং চিনতে ভুল হয়। ছানি হলে অপারেশন করতে হয়। তার আগে রক্তের বিটি ও সিটি পরীক্ষা করাতে হয়।

প্যাংক্রিয়াটাইটিস
এই রোগটি ক্রনিক এবং অ্যাকিউট দু ধরনের হতে পারে। বিভিন্ন কারণে এ রোগ হতে পারে। যেমন অতিরিক্ত মদ্যপান, গলব্লাডারে স্টোন, ভাইরাল ইনফেকশন ইত্যাদি। এ রোগের লক্ষণ পেটের সাংঘাতিক যন্ত্রণা যা ক্রমশ  পেছন দিকে চলে যায়, বমি হয়, কনস্টিপেশনের চাপ বাড়ে। রোগের লক্ষণ দেখে প্যাংক্রিয়াটিস হয়েছে কি না বোঝা যায়। তবে কনফার্ম হতে রক্তের অ্যামাইলেজ ও লাইপেজ এবং আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হয়।

মেয়েদের অসুখ
নানা রকম মেয়েলি অসুখের রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন টেস্ট ও রোগের নানা উপসর্গের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো-

ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড
ইউটেরাসের ব্যাপারে অনেক মহিলার মনে একটা অবসেশন আছে। পিরিয়ডের কোনো গোলমাল হলেই তারা ভাবেন যে বোধহয় ইউটেরাসে টিউমার হয়েছে। ইউটেরাসে টিউমার খুব একটা কমন ব্যাপার।

ফাইব্রয়েডের অবস্থান অনুযায়ী এই সমস্যার উপসর্গ দেখা যায়। যেমন ফাইব্রয়েড যদি বাইরের দিকে থাকে তা হলে সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। ইউটেরাসের ভেতরের দিকে ফাইব্রয়েড থাকলে পিরিয়ডের সময়ে বেশি ব্লিডিং হয়, আর মাংসপেশির মধ্যে থাকলে বেশি ব্লিডিং তো হয়ই, তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাও থাকে।
টেস্ট
জরায়ুর বাইরের দিকের টিউমারে যেহেতু কোনো উপসর্গ থাকে না সেহেতু ধরা খুব শক্ত। যদি টিউমারের সাইজ খুব বড় হয়ে যায় তখন হাত দিয়ে বোঝা যায়। এছাড়া বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে এলে টিউমার ধরা পড়ে। আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমেও টিউমারের আকার ও অবস্থান ধরা পড়ে। ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমেও নিখুঁত ছবি পাওয়া যায়। অপারেশন করতে হলে রক্তের সব রকমের রুটিন পরীক্ষা করতে হয়।

ওভারির সিস্ট
যে কোনো বয়সের ঋতুমতী মেয়ের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর কোনো উপসর্গ থাকে না। কোনো কারণে আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হলে সহজেই এই রোগটি ধরা পড়ে। ইউএসজি করে সিস্টের সাইজ দেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো গ্রোথ থাকলেও তা ধরা পড়ে। বেশি সিস্ট হলে এবং আকারে বড় হলে তলপেট ভারী লাগে। কখনো কখনো সিস্ট ঘুরে যেতে পারে। তখন পেটে অসহ্য ব্যথা হয়। অনেক সময়ে এই ব্যথা অ্যাপেন্ডিসাইটিস বলে ভুল হতে পারে, তবে আলট্রাসনোগ্রাফি করে বোঝা যেতে পারে। তার পরে ল্যাপারোস্কোপি বা ওপেন সার্জারি করা হয়।

এন্ডোমেট্রিয়োসিস
বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের মধ্যে এই রোগটির প্রকোপ বাড়ছে অথবা হয়তো রোগটি বেশি ধরা পড়ছে। বন্ধ্যাত্বের একটা বড় কারণ এই রোগটি। শুরু হয় পিরিয়ডের সময় পেটের যন্ত্রণা দিয়ে। ব্যথার দিনগুলো ক্রমশ বাড়তে থাকে, পিরিয়ড শেষ হলেও যন্ত্রণা শেষ হয় না। ব্লিডিং বেশি হয়, সঙ্গে থাকে ইনফার্টিলিটি। রোগের উপসর্গ থেকেই মোটামুটি ব্যাপারটা বোঝা যায়। রোগ ধরা পড়ে ডায়াগনোস্টিক ল্যাপারোস্কোপি করলে। এই রোগ বেড়ে গিয়ে চকোলেট সিস্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আলট্রাসনোগ্রাফি করে রোগ ধরা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান
ডিজিজ বা পিসিওডি
অসুখটা ওভারির হলেও হয় হরমোনের জন্য। এছাড়া কিছুটা হয় হরমোনের তারতম্যের জন্যও। এর প্রধান উপসর্গ হলো ওজন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। নিয়মিত অভিউলেশন হয় না বলে পিরিয়ডের গোলমাল হয়; এমনকি অনেক সময়ে ৬-৭ মাস পিরিয়ড বন্ধ থাকে। মুখে প্রচুর ব্রন বেরোয়। বয়োসন্ধির ছেলেদের মতো গোঁফের রেখা দেখা যেতে পারে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশে লোম দেখা দিতে পারে। মোটামুটি উসপর্গ দেখে পিসিওডি সন্দেহ করা হয়। রোগ নির্ণয় করতে রক্তের নিম্নলিখিত হরমোনগুলোর মাত্রা মাপা হয় পিরিয়ডের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দিনে। হরমোনগুলো হলো, এফএসএইচ, এলএইচ, টিএসএইচ, প্রোল্যাক্টিন, ফ্রিটেস্টোস্টেরন- টোটাল টেস্টোস্টেরন, অ্যান্ড্রোস্টেরন, ডিহাইড্রোএপিঅ্যান্ড্রোস্টেরন, ডিহাইড্রোএপিঅ্যান্ড্রোস্টেরন সালফেট হরমোন টেস্ট। এই রোগের চিকিৎসা না হলে নানা রকম রোগ দেখা দিতে পারে। সুতরাং পিরিয়ডের সমস্যা হলে অবিলম্বে গাইনোকলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।

ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন
(বিকোলাই)
লেম্যানস টার্ম বিকোলাই হলেও বিশেষজ্ঞরা একে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন বলেন।
সদ্যোজাত থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সের মানুষের ইউটিআই হতে পারে। তবে মেয়েদের এই অসুখের প্রবণতা খুব বেশি। এ রোগে আক্রান্ত হলে বারে বারে বাথরুমে যেতে হয়, প্রস্রাব চেপে রাখা যায় না, তলপেটে ব্যথা করে। ব্যথা কখনো কখনো পিঠের দিকে চলে যেতে পারে। আবার প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তও পড়তে পারে। এ রোগের কারণ জানতে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে হয়। যেমন রক্তের টিসিডিসি, হিমোগ্লোবিন, ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন। ইউরিন কালচারও টেস্ট করাতে হয়। এছাড়া স্টোন আছে কি না দেখতে কিডনি ও ব্লাডারের এক্স-রে করাতে হতে পারে।

প্রস্টেটের অসুখ
বারে বারে প্রস্রাব পাওয়া, প্রচণ্ড জোরে প্রস্রাব পেলেও শুরু হতে দেরি হওয়া, বাথরুম থেকে ঘুরে এলেও মনে হওয়া যে আবার প্রস্রাব পাচ্ছে, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি। ৫০-এর বেশি বয়সে এসব সমস্যা দেখা দিলেই ইউরোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ইউরোলজিস্ট প্রথমে রেক্টাল পরীক্ষা করেন। রক্তের রুটিন পরীক্ষা প্রস্টেটসেপসিফিক অ্যান্টিজেন টেস্ট করাতে হয়। এছাড়া প্রয়োজন হলে তলপেটের আলট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে, রেডিও আইসোটোপ স্টাডি করাতে হতে পারে। সব সময়ে অপারেশনের দরকার পড়ে না। ওষুধের সাহায্য নিয়ে সারানো যায়।

কিডনি স্টোন
বারে বারে ইউরিনারি ইনফেকশন হচ্ছে, কোমরে যন্ত্রণা হচ্ছে, জ্বর আসছে, অবশ্য কোনো কোনো সময়ে শুধু কোমরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে এমন সমস্যাও দেখা দিতে পারে। কারো আবার প্রস্রাবসংক্রান্ত কোনো সমস্যাই থাকে না। একটু-আধটু হজমের গোলমাল হয়, গলব্লাডারে স্টোন হলে যেমন হয়। এসব সমস্যা দেখা গেলে রুটিন ইউরিন টেস্ট, পেটের এক্স-রে এবং আলট্রাসনোগ্রাফি করাতে হতে পারে। অনেক সময়ে কিডনিতে স্টোন থাকলেও সেই রকম কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে ইন্ট্রাভেনাস পাইলেগ্রাম নামে বিশেষ এক ধরনের পরীক্ষা করে কিডনি ও মূত্রনালির পরিষকার ছবি পাওয়া যায়।

বাতের ব্যথা
বাতের ব্যথার অনেক ডাক্তারি নাম আছে। অস্টিওপেরোসিস থেকে স্লিপ ডিস্ক যাই হোক না কেন উপসর্গ কিন্তু সেই ব্যথাই। কেন ব্যথা হচ্ছে জানার জন্য কী কী করা দরকার জেনে নিন...।

অস্টিও আর্থ্রাইটিস
৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে এই রোগ দেখা যায়। ওয়েট বেয়ারিং জয়েন্টে, যেমন হাঁটু, কোমর, গোড়ালি এসব জায়গায় ও মেরুদণ্ডে এই রোগ দেখা যায়। মেরুদণ্ডে রোগের ক্ষেত্রে ঘাড়ে ব্যথা হলে তখন বলা হয় সারভাইকাল সপনডাইলোসিস এবং কোমরে ব্যথা হলে বলে লাম্বার সপনডাইলোসিস। এই রোগের উপসর্গ হলো ব্যথা। কখনো ক্রনিক, কখনো বা অ্যাকিউট। অ্যাকিউট পেনের সময়ে জয়েন্ট ফুলে উঠে লাল হয়ে যেতে পারে। রোগ নির্ণয় করতে রক্তের রুটিন টেস্ট, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করাতে হতে পারে।

অস্টিওপেরোসিস
অস্টিওপেরোসিস মূলত মেয়েদের মেনোপজের পরে দেখা দেয়। এতে গায়-হাত-পায়ে ব্যথা হয়, হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় ভেঙে যায়। এইচআরটি করে সারানো যায়। চিকিৎসার আগে এক্স-রে বোন ডেনসিটি টেস্ট করতে হয়। এছাড়া রক্তের সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট, ফসফেট টেস্ট এবং কিছু কিছু হরমোনের টেস্ট করাতে হয়।

প্রোল্যাপ্সড ডিস্ক
কোমরে বা ঘাড়ের কাছে শিরদাঁড়ার দুটি হাড়ের মধ্যবর্তী ডিস্ক সরে গিয়ে নার্ভের ওপরে চাপ পড়লে এই রোগটি হয়। সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করে এই রোগের ধরনটা ডিটেক্ট করা যায়।

হারপিস জস্টার
জল ফোসকার মতো গুটি দেখা যায়, সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। এই হলো হারপিসের প্রধান উপসর্গ। সাধারণত চোখে দেখেই রোগ নির্ণয় করা যায়। তবে তান্‌ক টেস্ট করে নিয়ে কনফার্ম করা হয়।

টেস্ট সমাচার
আলট্রাসনোগ্রাম
শব্দতরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে একটি বিশেষ ধরনের মেশিনের সাহায্যে লিভার, কিডনি, ইউটেরাস, গলব্লাডার, গর্ভস্থ শিশু ইত্যাদির পরিষকার ছবি পাওয়া যায়। আলট্রাসনোগ্রাম করার আগে (বিশেষত কেইউবি ও বাচ্চার জন্য) দু-তিন গ্লাস পানি খেয়ে প্রস্রাব চেপে রেখে করা হয়। এতে ছবি আরো পরিষকার হয়। ব্যথাহীন ও নিরাপদ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এই আলট্রাসনোগ্রাম।

সিটি স্ক্যান
কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি স্ক্যানে একরকম ডাই ইনজেকশনের সাহায্যে শিরায় প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এক্স-রের সাহায্যে শরীরের বিভিন্ন অংশের (ব্রেন টিউমার বা ব্লাডক্লট আছে কি না, মেরুদণ্ড, জয়েন্ট ইত্যাদি) ডিটেল ছবি তোলা হয়। ব্রেন ছাড়াও কিডনি ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গেরই সিটি স্ক্যান করা হয়।

এমআরআই
ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং টেস্টের সাহায্যে ব্রেনের ভেতরের পরিষকার ছবি ছাড়াও সব রকমের সফট টিস্যুর একটা থ্রি ডাইমেনশনাল ইমেজ পাওয়া যায়। যেমন খেলোয়াড়দের কাঁধ বা হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া থেকে স্লিপ ডিস্ক সবই ভালোভাবে জানা যায়। রোগীকে এক শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে শোয়ানো হয়। তারপর প্রয়োজন মতো বিভিন্ন অঙ্গের ছবি তোলা যেতে পারে।

বেরিয়াম এক্স-রে
ইন্টেস্টাইন, স্টমাক আর কোলনের কোনো গ্রোথ বা অস্বাভাবিকতা ধরতে বেরিয়াম এক্স-রে করা হয়। সাধারণভাবে এক্স-রে করলে স্টমাকের ছবি পাওয়া যায় না। বেরিয়াম সলিউশন খেয়ে কিছুক্ষণ পরে এক্স-রে করালে পরিষকার ছবি পাওয়া যায়।

এফএনসি
পুরো কথাটা হলো ফাইন নিড্‌ল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি। অর্থাৎ কোনো টিউমার গ্রোথ থেকে সুচের সাহায্যে রস বের করে পরীক্ষা করা হয়। টিউমারে কোনো ক্যান্সার কোষ আছে কি না বোঝার জন্য এই টেস্ট করতে হয়। পেটের লাম্পের ক্ষেত্রে সিটি গাইডেড এফএনএসি করার দরকার হয়।

ম্যামোগ্রাফি
ব্রেস্টের কোনো লাম্প হলে এমনকি লাম্প বোঝার আগেও ম্যামোগ্রাফি করে এর অস্তিত্ব বোঝা যেতে পারে। বিশেষ ধরনের এক্স-রের সাহায্যে ব্রেস্টের সমস্ত টিস্যুর একটা সপষ্ট ছবি পাওয়া যায়। ৪০ বছরের পরে মহিলাদের বছরে একবার করে ম্যামোগ্রাফি করালে ভালো হয়।

ইসিজি
ইস্কিমিয়া, হার্টের ইলেকট্রিক্যাল ব্লক এবং আগে কোনো হার্টঅ্যাটাক হয়েছে কি না তা জানতে ইসিজি করা হয়। ইসিজির গ্রাফে অনেকগুলো সেগমেন্ট আছে, যেমন এসটি-টি সেগমেন্ট। এই সেগমেন্টে ওঠানামা দেখে হার্টের অবস্থা বোঝা যায়। আর দৌড়ে ইসিজি করলে তাকে বলে টিএমটি।

ইইজি
মস্তিষেকর কোনো ইলেকট্রিক্যাল ডিসচার্জ পয়েন্ট আছে কি না জানা যায় ইইজি থেকে। এপিলেপসি হলে বা মস্তিষেক চোট লাগলে ইইজি করা হয়।

এসএফএ
পুরো নাম হলো সন্ডার্স ফ্লিউরোসেন্ট এনজিওগ্রাফি। রেটিনার অসুখ নির্ণয় করতে এই পরীক্ষা করা হয়। চোখে এক বিশেষ ধরনের ফ্লিউরোসেন্ট ডাই ইনজেকশন দেয়া হয়। এতে রেটিনার রক্তবাহী নালির পরিষকার একটা চিত্র পাওয়া যায়।

এন্ডোস্কোপি
খাদ্যনালি বা ইসোফেগাস ও অন্ত্রের কোনো টিউমার বা আলসার আছে কি না দেখার জন্য অথবা ইন্টেস্টাইনের কোনো সমস্যার পরিষকার ছবির জন্য এন্ডোস্কোপি করা হয়। খালি পেটে লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া করে গলার ভেতর দিকে সরু পাইপের মধ্যে করে ক্যামেরা ও লাইট পাঠিয়ে বাইরের মনিটরে পেটের ছবি দেখা হয়।

ফিডাল টেস্ট
টাইফয়েডের জীবাণু নির্ণয় করতে রক্তের এই পরীক্ষাটি করা হয়। যে কোনো সময়েই রক্ত দেয়া যেতে পারে।

টিসিডিসি, ইএসআর, হিমোগ্লোবিন
ইএসআর করাতে গেলে খালি পেটে রক্ত দিতে হয়। অন্য পরীক্ষাগুলোতে যে কোনো সময়ই রক্ত দেয়া যায়। এগুলো রক্তের রুটিন টেস্ট। যে কোনো অসুখ-বিসুখ, অপারেশনের আগে এই টেস্ট করাতে হয়।

লিপিড প্রোফাইল
হাইপারটেনশন, হার্টের রোগ বা সেরিব্রাল অ্যাটাকের রোগীদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা জানতে লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করা হয়। ১২ ঘণ্টা কিছু না খেয়ে এই টেস্ট করাতে হয়।

ইউরিক এসিড,
ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন
কিডনির কাজকর্ম ঠিকঠাক না চললে রক্তে ইউরিক এসিড, ইউরিয়া ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যায়। সকালে খালি পেটে রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। রেডিও আইসোটোপ স্টাডি-একটা বিশেষ ধরনের ইনজেকশন দিয়ে আইসোটোপ স্ক্যানার নামে একটি উন্নত প্রযুক্তির মেশিনে গামা ক্যামেরার সাহায্যে কোনো নডিউল বা টিউমারের ছবি তোলা হয়। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের সলিটারি নডিউলের চরিত্র জানতে (বিশেষত এই ম্যালিগন্যান্ট কি না) রেডিও আইসোটোপ স্টাডি করা হয়। একে নিউক্লিয়ার ইমেজিংও বলে।

আপনার চিকিৎসা
ঠিকমতো হচ্ছে তো?
শতকরা একশো ভাগ সত্যি যারা এই সেন্টারগুলো চালান, তারা তো কোনো মিশন চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগুলো চালান না, চালান ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাদের ব্যবসার মূল স্তম্ভ তো ডাক্তারগণ। তারা যদি কেস না পাঠান তবে তো মাছি মারতে হবে, রুজি রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে, স্টাফরা মাইনেপত্তর পাবেন না। কাজেই এতটাই যাদের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেই লক্ষ্মীমন্ত ডাক্তারদের সামান্য উপঢৌকন (অর্থ বা অনর্থ) দেবেনই। এখন প্রশ্ন হলো ডাক্তাররা নেবেন কি না। এটা সত্যি, অনেকেই কমিশন নেন। আবার এটাও সত্যি, অনেকেই নেন না নৈতিকতার প্রশ্নে, মূল্যবোধের প্রশ্নে। কিন্তু তাতে রোগীদের কি আসে যায়। ডাক্তার কমিশন নেন না বলে তার রোগী তো আর সেই বেনিফিট পাচ্ছেন না। তাকে তো অন্য রোগীর মতোই রেটচার্টে ছাপানো মূল্যই দিতে হচ্ছে। একই রক্ত পরীক্ষার জন্য একদল রোগী যাদের ডাক্তাররা কমিশন নেন না এবং আরেক দল রোগী যাদের ডাক্তাররা কমিশন নেন, এই দু দল দু রকম মূল্য দিচ্ছে একই ল্যাবরেটরিতে, এমনটা কেউ কখনো শুনেছেন? কাজেই ডাক্তার কমিশন নিল কি না নিল, তাতে রোগীদের কিছুই আসে যায় না, কোনো দিন যায়ওনি। অন্য ব্যবসার মতো ল্যাবরেটরির ব্যবসায় এই প্রথা চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। আর কমিশন না দিয়ে অন্য কোনোভাবে যদি কেউ ডাক্তারদের সঙ্গে মসৃণ সম্পর্ক রাখতে চায়, আটকাবেন কী করে? আমার তো মনে হয় চাঁদে মানুষের বসতি হলে সেখানকার ল্যাবরেটরি থেকেও পৃথিবীর ডাক্তারদের জন্য কমিশন আসবে। কাজেই ডাক্তার কমিশন না নিলে রোগীর কোনো লাভ নেই, লাভ ইনভেস্টিগেশন সেন্টারের মালিকদের, টাকাটা ফিরে এসে তাদের কোষাগারেই জমা হয়।

এই অভিযোগ প্রায় শোনা যায়, এমনকি ডাক্তাররাই বেশি করেন, তমুক জায়গার রিপোর্ট ভালো না, কেন ওখান থেকে করালেন কিংবা একই সঙ্গে দু জায়গায় একই পরীক্ষা করলে দু’রকম রিপোর্ট আসে।
এই অভিযোগ অনেকটাই সত্যি। এই যে গ্রাম, মফস্বল বা শহরে এত সেন্টার গজিয়ে উঠছে, এদের স্ট্যান্ডার্ড কতটা ঠিক? কিন্তু কথা হলো, এই বিচারটা করবে কে? এদের তো জেলা স্বাস্থ্য দফতর থেকে লাইসেন্স নিতে হয় ব্যবসা করতে হলে। সে জন্য অনেক নিয়ম মানতে হয়। এগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব তো সেই দফতরেরই। এ জন্য সরকারের মাইনে করা কর্মীও আছেন। ইদানীং কিছুটা হলেও সবার ভেতরে কিছুটা সচেতনতা দেখা যাচ্ছে। এর আগে তারা কীভাবে ব্যবসা চালিয়েছেন সেটা সবারই জানা। শুধুমাত্র কমিশনের লোভে যদি কোনো ডাক্তার এই হ্যান্ডিক্যাপড দুনম্বরি সেন্টারগুলোতে কেস পাঠিয়ে থাকেন, তবে তিনি যে গর্হিত কাজ করেছেন তা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না।
ডাক্তারগণ তাদের পছন্দমতো সেন্টারে পরীক্ষা করাতে বলেন কেন? নিছক কমিশনের জন্য?
আগেই বলেছি ব্যবসা চালু রাখার জন্য কমিশন দেয় অধিকাংশ সেন্টারই এবং সেগুলোর পরিমাণ কমবেশি একই রকম। কাজেই শুধু কমিশনের জন্য ডাক্তারগণ এটা করবেন কেন? আসলে রোগীর যেমন ডাক্তার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে, ভরসার ব্যাপারও আছে। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, মেডিসিনের অধ্যাপক। চেম্বারের পাশের ঘরে তার রোগীর রক্ত-মল-মূত্রের ছোটখাটো পরীক্ষা তিনি নিজেই করে নিতেন, অন্যদের ওপর তার ভরসা কম ছিল, না ঠেকলে রোগী পাঠাতেনও না অন্য ল্যাবে।

তবে ঠিকমতো রিপোর্ট না পেলে কোনো ডাক্তারই দীর্ঘদিন এক ল্যাবে রোগী পাঠান না, যত কমিশনই তারা দেন না কেন। কারণ এই রিপোর্টের ওপরই তো রোগীর চিকিৎসা হবে, রোগীকে দ্রুত ভালো করার উপরেই তো নির্ভর করছে ডাক্তারের সুনাম, তার প্র্যাক্টিস। কোনো দু নম্বরি সেন্টারকে ব্যাক করতে গিয়ে সুস্থ মস্তিষেকর কোনো ডাক্তারই চাইবেন না তার নিজের বদনাম।
ডাক্তারগণ আজকাল এত পরীক্ষা করান কেন, আগে তো করাতেন না? সবটাই কমিশনের লোভে?
আগে তো পরীক্ষা আবিষকার হয়নি, বিজ্ঞান এতটা এগোয়নি, কাজেই ডাক্তারগণ এসব লিখবেন কী করে! অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ধকারে ঢিল ছোড়াটাই ছিল ভবিতব্য কিংবা নাড়ি ধরে নিদান দেয়া। ভাগ্যিস তখন ক্রেতা সুরক্ষা আইন ছিল না, থাকলে শতকরা নব্বইজন ডাক্তারকেই কোর্টে টেনে নিয়ে বেইজ্জত করার সুযোগ পাওয়া যেত। আর তা ছাড়া তখন তো ডাক্তার মানেই ছিলেন ভগবান। কাজেই তিনি যে ডায়াগনোসিস করছেন, তাতেই শতকরা একশভাগ আস্থা ছিল রোগী এবং তার বাড়ির লোকদের, সেকেন্ড ওপিনিয়ন নেয়ার কথা কজন ভাবতেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারগণ ভগবান থেকে শয়তান হয়ে যাওয়াতেই এই বিপত্তি। ইদানীংকালে ইনভেস্টিগেশন করাবেনই। এটা হলো রোগীর স্বার্থে। আরেকটাও স্বার্থ আছে, সেটা হলো নিজেদের পিঠ বাঁচানো। ক্রেতা সুরক্ষা আইন, মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতাদের চোখরাঙানি, রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ছিদ্রসন্ধানী মনোভাব-অনেক হ্যাপা সামলে এ যুগের ডাক্তারদের প্র্যাক্টিস করতে হয়।

স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা চলছে
ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের দায়বদ্ধতা নেই। অল্প খরচ করে মুনাফা তোলাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। সেখানে না আছে সুযোগ্য প্যাথলজিস্ট, ভালো রেডিওলজিস্ট অথবা দক্ষ টেকনিশিয়ান। এই ধরনের বেশির ভাগ ল্যাবেই দায়সারাভাবে কাজ হয়। অবশ্য সব ডায়াগনোস্টিক সেন্টারই এ রকম নয়। গ্রামে-গঞ্জেও বেশ কিছু ভালো ল্যাবরেটরি চালান অভিজ্ঞ প্যাথলজিস্টরা। এ প্রসঙ্গে এটাও জেনে রাখা ভালো যে কিছু অনভিজ্ঞ চিকিৎসক অপ্রয়োজনেও গাদাগাদা টেস্ট করাতে বলেন। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো টেস্টের রিপোর্ট দেখে রোগ নির্ণয় করতে চেষ্টা করেন।

নামি জায়গা ছাড়া টেস্ট করাই না
আমি কখনো ছোটখাটো প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির ওপর আস্থা রাখতে পারি না। কেননা আমার বেশ কয়েকজন রোগী এবং নিজের ক্ষেত্রেও এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে যে, আমি পাড়ার ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ডায়াগনোসিসের ওপরে পুরোপুরি ভরসা হারিয়ে ফেলেছি। প্রথমে আমার পেসেন্টের কথা বলি। ভদ্রমহিলা যে সব সিম্পটম নিয়ে আমার কাছে এলেন, দেখেই মনে হলো ওর ব্লাডসুগার হয়েছে। ফ্যামিলি হিস্ট্রিতেও ডায়াবেটিস আছে। তাও কনফার্ম হওয়ার জন্য আমি ওকে ব্লাডসুগার টেস্ট করাতে বললাম পিপি এবং ফাস্টিং দুটোই। উনি স্থানীয় কোনো ল্যাব থেকে টেস্ট করালেন এবং রিপোর্টে দেখলাম দুটো একদম নর্মাল। মানে ফাস্টি-এ ৮০ আর পিপি-র রিপোর্টে ১২০। আমার মনে খুব সন্দেহ হলো। তাই এবারে ওকে ভালো কোনো ল্যাব থেকে আরেকবার টেস্ট করাতে বললাম। এবারে রিপোর্ট এল ব্লাডসুগারের মাত্রা প্রায় ৩৫০।

রিএজেন্ট কিট ভালো না হলে
রেজাল্ট নিয়ে সংশয় থাকে
প্যাথলজিস্ট, এএমআরআই হাসপাতাল ছোটখাটো ল্যাবরেটরিতে রক্তের হিমোগ্লোবিন বা গ্রুপ টেস্ট এ রকম ছোটখাটো কিছু পরীক্ষা ছাড়া অন্য টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশয় থাকে। কেননা এই ধরনের বেশির ভাগ ল্যাবে লেটেস্ট টেকনোলজির ভালো মেশিন বা রিএজেন্ট কিট ব্যবহার করা হয় না। তার সঙ্গে কোয়ালিফায়েড প্যাথলজিস্ট বা অ্যাফিশিয়েন্ট টেকনিশিয়ানের ঘাটতি তো আছেই। অনেক ক্ষেত্রেই টেকনিশিয়ানদের হেল্পারকে দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেয়া হয়। এসবের জন্যই ভালো ল্যাবের থেকে অলিগলির ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের রেজাল্টের এতটাই ফারাক হয় যে আখেরে রোগীরই ক্ষতি হয় বেশি; সে সঠিক চিকিৎসা পায় না। বিশেষত এলাইজা টেস্ট, রেডিও ইমিউনো অ্যাসো বা টিএসএইচ লেভেল টেস্টের জন্য একটা ল্যাবরেটরির যে ধরনের পরিকাঠামোর প্রয়োজন হয় ছোটখাটো ল্যাবে সেটা আশা করা যায় না।

ভরসা করে ঠকতে হয়
একবার আমার কাছে একটি আট-নয় বছরের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে আসা হয়। বাচ্চাটি লাগাতার সর্দি-কাশি আর জ্বরে ভুগছিল। কফের সঙ্গে রক্ত পড়ছিল। ওর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করলাম। একই সঙ্গে একটা চেস্ট এক্স-রে আর সপুটাম টেস্ট করাতে বললাম। স্থানীয় এক প্যাথলজিক্যাল সেন্টার থেকে ওর বাবা টেস্ট করিয়ে আনলেন। রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমি স্তম্ভিত। রিপোর্টে লেখা ওর দুটো ফুসফুসই যক্ষ্মার আক্রমণে ঝাঁঝরা। কিন্তু আমার ‘ক্লিনিক্যাল আই’ সে কথা বলছে না। আমি আবার এক্স-রে করাতে বললাম এবং উল্লেখ করে দিলাম একটা নামি এবং ভালো ল্যাবের নাম। বলাই বাহুল্য সেখানকার রিপোর্ট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাচ্চাটির বাবা অনেক বেশি সতর্ক, তিনি নামকরা একটি ভালো ল্যাব থেকে আরও একটি টেস্ট রিপোর্ট এনেছেন, তাতে দেখা গেল বাচ্চার শরীরে যক্ষ্মার জীবাণুর লেশমাত্র নেই।

অভিযোগ মিথ্যা বলা যাবে না
রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকরা কমিশন পান, এমনকি প্রয়োজন নেই এমন পরীক্ষাও চিকিৎসকরা কমিশনের লোভে করতে বলেন এ অভিযোগ পুরনো। অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। প্রতিষ্ঠিত নামি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলো চিকিৎসকদের কমিশন দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কিন্তু অনামি ভুঁইফোড় ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলো প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য চিকিৎসকদের কমিশনের লোভ দেখায়। ভোগবাদের যুগে চিকিৎসকরা কোনো সমাজবহির্ভূত জীব নয়। কাজেই কিছু চিকিৎসক প্রলোভনের শিকার হন। সে জন্য সমগ্র চিকিৎসক সম্প্রদায়কে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হলে সেটা অবিচার করা হবে। কোনো এক চিকিৎসক যদি তার সব রোগীকে সবসময় কোনো এক বিশেষ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে সব রকম পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন, তখন মনে কমিশনসংক্রান্ত সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয়।