শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের পড়াশোনা বা
পাঠচর্চার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে অধীত বিষয়গুলো মনে রাখা। আর মনে রাখার বা
মনে থাকার সাফল্যের ওপরই নির্ভর করে জ্ঞানার্জন তথা পরীক্ষার খাতায়
যথাযথভাবে উত্তর লেখার ক্ষমতা। কিন্তু মনে রাখার এই ক্ষমতা সবার সমান নয়।
ব্যক্তিভেদে এ ক্ষেত্রে সপষ্টতই পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ কম পড়াশোনা করেও
বেশি মনে রাখতে পারছে, আবার কেউ প্রচুর পড়াশোনা করেও বেশি মনে রাখতে পারছে
না। এ নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে নানা অভিমত, নানা অনুযোগ।
অধীত বিষয়গুলো মনে রাখার ক্ষেত্রে মেধা বা প্রকৃতিগত ক্ষমতা কম বা বেশি
যা-ই হোক না কেন, কীভাবে অধীত বিষয়গুলো আরো গভীরভাবে মনে থাকে বা মনে রাখা
যায় তা নিয়েও হচ্ছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা। আর তা থেকেই বেরিয়ে
এসেছে কিছু কৌশল। স্টাডি কাউন্সেলররা উদ্ভাবিত এসব কৌশল প্রয়োগ করে
সাফল্যেরও প্রমাণ রেখেছেন। বলা যেতে পারে, উদ্ভাবিত কৌশলগুলো কার্যত
পড়াশোনায় নিবিড় মনোযোগ কিংবা পাঠদক্ষতা বাড়ানোর জন্য।পাঠে নিবিড় মনোযোগ
১. শিডিউল নির্ধারণঃ পড়াশোনার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের পাশাপাশি চিত্তবিনোদন ও সামাজিক কার্যক্রমের জন্যও সময় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে পড়াশোনার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের মধ্যেও বেশি সময় ব্যয় করতে হবে অধিকতর কঠিন বিষয়ের ক্ষেত্রে।
২. বিরতিসহ পড়াঃ পড়াশোনার মাঝে বিরতি প্রয়োজন। সাধারণত একটি বিষয়ে গড় মনোযোগ ক্ষমতা মোটামুটিভাবে ২০ মিনিট। মুখস্থ করার লক্ষ্যে দ্রুত এবং একাধারে দীর্ঘ সময় পড়া অনুচিত। বরং একটি বিষয়ের কিছু অংশ পড়ার পর সাময়িক বিরতি দিয়ে আবার মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
৩. এককালীন পাঠের সময়মাত্রাঃ একটানা পাঠের সময়সীমা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো উচিত। প্রথমাবস্থায় ১০ মিনিট থেকে ১৫ মিনিট মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে এ সময়সীমা বাড়িয়ে ২০, ২৫, ৩০ কিংবা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
৪. পুরস্কৃত কর নিজেকেঃ ভালো পড়াশোনা কিংবা একটি কঠিন বিষয় আয়ত্ত করার পর নিজেকে পুরস্কৃত কর। আর সে পুরস্কারটি হতে পারে নানাভাবে। হতে পারে একটি টিভি অনুষ্ঠান দেখা কিংবা বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে গল্প করা। এভাবে যখন তুমি জানবে যে পাঠের কঠিন অংশটি সমাপ্ত করার পর একটি রিওয়ার্ড রয়েছে, তখন তুমি আরো মনোযোগসহকারে পাঠটি সমাপ্ত করতে উৎসাহিত হবে।
৫. একটি উপযুক্ত স্থান বেছে নাওঃ এমন একটি স্থান খুঁজে নাও, যেখানে তোমার পড়াশোনার মনোযোগ বাড়বে এবং তোমার পাঠাভ্যাস সঠিকভাবে গড়ে উঠবে। তোমার বসার ব্যবস্থা যাতে আরামদায়ক হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তবে তা যেন অতিরিক্ত আরামদায়ক না হয় সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্যই বিছানায় শুয়ে শুয়ে না পড়ে ডেস্কে পড়া উত্তম।
৬. পাঠের জন্য একই স্থানঃ প্রতিদিন একই স্থানে পাঠের জন্য ব্যবহার করা ভালো। এতে মনোনিবেশ সহজ হবে।
৭. নির্জনতাঃ একই সঙ্গে একটি কোলাহলমুক্ত আলোকোজ্জ্বল, নীরব স্থান খুঁজে নিতে হবে পাঠচর্চার জন্য। অদূরে একটি রেডিও-টেলিভিশন বা স্টেরিওর শব্দ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা ইত্যাদি পাঠচর্চায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটিয়ে থাকে।
৮. বিক্ষিপ্তচিত্তঃ চারপাশে নানা বিষয়, ছোট ছোট নানা ঘটনা শিক্ষার্থীকে বিক্ষিপ্তচিত্ত করে তোলে। ফোনকল, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবের গল্পগুজব, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এমনকি দৃষ্টিসীমায় অন্য শ্রেণীর বইপত্রও তোমার চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে।
পাঠ কার্যকারিতা বৃদ্ধি
জরিপঃ পঠিতব্য বিষয়ের পুরো অধ্যায়টি বিশদভাবে জরিপ কর। লেখকের নাম ও হেডিং পাঠ কর। এ পর্যায়ে তোমাকে বিষয়টির গভীরে যেতে হবে না, বরং পুরো পাঠকাঠামোটি সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা সৃষ্টিই এ পর্যায়ের লক্ষ্য। এ পদক্ষেপের ফলে তুমি কী পড়তে যাচ্ছ, সে সম্পর্কে একটি মানসিক প্রস্তুতি এবং সাধারণ ধারণা তৈরি হয়ে যাবে।
নিজে নিজে প্রশ্ন তৈরি
যে বিষয়গুলো তুমি পড়েছ সে বিষয়ে আরো গভীরভাবে ভাব। এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিজেকে প্রশ্ন কর। এ পদক্ষেপ তোমার অধীত বিষয়ের সঙ্গে তোমাকে যুক্ত রাখতে সহায়তা করবে। তুমি যদি শিক্ষক হতে, তাহলে এই অধ্যায় থেকে তুমি কেমন ধরনের প্রশ্ন তৈরি করতে, সে রকম প্রশ্ন তৈরি করতে চেষ্টা কর। এর ফলে তোমার মনোযোগ বাড়বে এবং পরীক্ষার জন্য তোমার প্রস্তুতি আরো শাণিত হবে।
পড়া
সতর্কতার সঙ্গে পড় এবং তুমি নিজে নিজে যেসব প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছ, সে সবের উত্তর দ্রুত দিতে চেষ্টা কর। মনে রাখবে, টেক্সটি তুমি যেভাবে পড়বে, তার সঙ্গে একটি গল্প বা উপন্যাস পড়ার পার্থক্য থাকতে হবে। টেক্সট বই পড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অধিকতর মনোযোগ। তোমার এ পড়াগুলো কেবল বেশি বেশি পৃষ্ঠাসংখ্যা শেষ করা নয়, বরং এর বিষয়বস্তুর ভেতর প্রবেশ করা। পড়ার এ প্রক্রিয়াটি তোমার বোঝার ক্ষমতা বাড়াবে। যখন তুমি ক্লান্ত হবে কিংবা পাঠবহির্ভূত বিষয়ে প্রভাবিত হয়ে অমনোযোগী হতে শুরু করবে, তখনকার মতো পড়া বন্ধ করে দেবে।
লেখা
যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করবে তা খাতায় লিখে ফেলবে। তথ্যগুলো তোমার নিজের ভাষায় লিখবে এবং যতটা সম্ভব সেগুলো আবার পরিবর্তিত ভাষাকাঠামোতে লিখবে, যাতে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পার।
রিসাইট
যেসব বিষয় তুমি পড়েছ, সেগুলো যতটা মনে আছে তা আবার মনে করবে এবং প্রশ্নের উত্তরগুলো সশব্দে বলবে এবং তা শুনে বুঝতে চেষ্টা করবে সেগুলো সঠিক ও সম্পূর্ণ কি না। সঠিক মনে না হলে তা পুনরায় পড়বে এবং আবার উত্তরগুলো বলবে।
রিভিউ
তুমি কতটুকু শিখেছ এবং কোন অংশগুলোতে আরো মনোনিবেশ করা উচিত, তা বের করার উপায় হচ্ছে রিভিউয়িং। আর রিভিউয়িংয়ের সবচেয়ে উপযোগী সময় হচ্ছে পাঠ শেষ করার পর পরই। কারণ এ সময় পঠিত বিষয়গুলো ভালোভাবে মনে থাকে। এ সময় অধ্যায়ের প্রধান প্রধান পয়েন্ট সামারাইজ করার চেষ্টা করবে এবং পুনরায় মনে করবে। নিজের প্রস্তুতি পূর্ণ করার জন্য পঠিত উত্তরগুলো স্মৃতি থেকে দেয়ার চেষ্টা করবে।
কিছু সাধারণ পাঠকৌশল
পাঠদক্ষতা বাড়াতে নিবিড় মনোযোগ এবং পাঠ কার্যকারিতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ছাড়াও কিছু সাধারণ পাঠকৌশল অবলম্বন করলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে এবং পাঠের দক্ষতা অবশ্যই বাড়বে। এগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো ঃ
১. একই সময়ে নতুন ও পুরানো বিষয় না পড়াই উত্তম। এর ফলে একটি বিষয়ের স্মৃতিচারণা অন্য বিষয়টিকে মন থেকে মুছে দিতে চেষ্টা করে। উভয় ধরনের পড়ার মধ্যে সামান্য সময়ের বিরতি থাকা উচিত।
২. ক্লাসে উপস্থিতি বাড়াতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ক্লাসে উপস্থিতি ও মনোযোগ ভালো, তাদের গড় ফলাফলও ভালো।
৩. ক্লাস লেকচারের বিষয়গুলো অবশ্যই ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করবে। এসব বিষয় নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করবে এবং কোনো অংশ না বুঝলে শিক্ষকের কাছ থেকে জেনে নেবে।
৪. কোনো ক্লাস মিস করলে ওই ক্লাসে প্রদত্ত লেকচারের বিষয়গুলো জেনে নেবে।
৫. ক্লাস লেকচারের বিষয়গুলো তাৎক্ষণিক নোট করবে। বিষয়গুলো বইয়ে পাওয়া যাবে এমন ভেবে অন্যমনস্ক না থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও লিখবে।
৬. ক্লাসনোটের সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের লিখিত বিষয়ে সমন্বয় করে পড়বে। এতে মৌলিক বিষয়গুলো ভালোভাবে মনে থাকবে।
৭. সম্ভব হলে একটি স্টাডি গ্রুপ তৈরি করবে। গ্রুপ সদস্যরা সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে গ্রুপ স্টাডির আয়োজন করবে। কোনো বিষয় আত্মস্থ করতে এ পদ্ধতিটি বিশেষ কার্যকর।
No comments:
Post a Comment