শিশুদের পড়ার অভ্যাস করাতে হলে...
আজকাল বাবা-মায়ের শিশুদের নিয়ে একটি কমন
অভিযোগ রয়েছে, তাদের শিশুরা পড়তে চায় না। কিন্তু, ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করার
জন্য ও কোনো বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্য পড়ার তো কোনো বিকল্প
নেই। আসলে না পড়তে চাওয়া বিষয়টি শুধু শিশু নয়, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও
বিদ্যমান। মন থেকে আন্তরিকভাবে কিছু পড়ার অভ্যাস আমাদের যেন কমেই চলেছে।
বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে খুব
অল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণী খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের
গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, কিংবা কবিতা। খুব কম সংখ্যা ছেলেমেয়েই পড়ছে
নামিদামি সব ম্যাগাজিন, জার্নাল কিংবা রিসার্চধর্মী বই। তাছাড়া এ কথাটি তো
কমবেশি সবারই জানা যে, দি মোর ইউ রিড, দি মোর ইউ লার্ন! অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও
গুরুত্বপূর্ণ এ পড়ার অভ্যাসটি যদি শৈশব থেকেই সন্তানের মধ্যে গড়ে তুলে
দেয়া যায়, তাহলে প্রথম থেকেই ক্লাসে তাদের রেজাল্ট আশানুরূপ হওয়ার পাশাপাশি
তাদের যেমন গড়ে উঠবে নিয়মিতভাবে ভালো ভালো সব লেখাপড়ার অভ্যাস, তেমনি
প্রতিনিয়তই বাড়তে থাকবে তাদের জ্ঞানের পরিধি। আর পড়ার অভ্যাসটি একবার
ভালোমতো গড়ে উঠলে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা জীবনের জন্য ব্যক্তির মধ্যে
রয়ে যায়। এখন তাহলে জেনে নিন, শিশুদের মাঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য
বাবা-মায়েরা কী করতে পারেন, সেই বিষয়ে সেরা ১০টি টিপস।
১. সবার আগে নিশ্চিত হোন যে আপনার শিশুর বর্ণমালা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রয়েছেশিশুকে স্কুলে ভর্তি করার আগেই বাসায় খেলতে খেলতে বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা দিন। তাকে অক্ষর শেখান। ইংরেজি অক্ষরগুলো শেখানোর সময় ছোট ও বড় হাতের অক্ষরগুলোর পার্থক্য ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিন। এতে স্কুলে ভর্তির পর যখন সে দেখবে সে ভালো পারছে, তখন তার আত্মবিশ্বাসও যেমন বাড়বে, তেমনি দূর হয়ে যাবে স্কুলভীতিও। আর পড়ার পূর্বশর্ত তো অবশ্যই অক্ষর ও শব্দগুলো।
২. প্রতিদিনই শিশুদের সঙ্গে কিছু না কিছু পড়ুন ও পড়ান
প্রতিদিনই শিশুর সঙ্গে কিছু না কিছু পড়ার চেষ্টা করুন। পড়ার জন্য এমন কোনো বিষয় বেছে নিন যা শিশুর সঙ্গে সঙ্গে আপনারও ভালো লাগবে। সেটা হতে পারে অত্যন্ত ছন্দময় মজার কোনো সহজ কবিতা, হতে পারে ছোট কোনো গল্প বা রূপকথা, কিংবা হতে পারে টিনটিনের মতো মজার ও জনপ্রিয় কোনো চরিত্রের কার্টুন বই। তবে অবশ্যই লক্ষ রাখবেন যে, একই বই যেন বারবার না পড়ানো হয়ে যায়। একই বই বারবার পড়ালে তাদের কাছে বিষয়টি বোরিং হয়ে যেতে পারে।
৩. নার্সারি লেভেলের ছড়াগুলো শিশুদের সঙ্গে পড়ুন ও পড়ান
শিশুকে স্কুলে ভর্তির আগে তাকে নার্সারি লেভেলের ছড়াগুলো শিখিয়ে দিন। তাদের প্রয়োজনে ছড়াগুলো অভিনয় করে পড়ান, সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও অভিনয় করে আবৃত্তি করতে বলুন। বইয়ে ছাপা কবিতার শব্দগুলোতে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে পড়তে বলুন। ধীরে ধীরে তাদের কবিতাটি মুখস্থ করে দিন। যখন সে নার্সারিতে ভর্তি হবে, তখন সেই হয়তো এগিয়ে থাকবে সবার চেয়ে বেশি, আর পড়ালেখায় তার আগ্রহও বেড়ে যাবে বহুগুণ।
৪. শিশুদের জন্য পড়ার পরিবেশ তৈরি করে দিন
যদি সম্ভব হয় তাহলে শিশুর জন্য আলাদা একটি পড়ার রুমের ব্যবস্থা করে দিন। তা সম্ভব না হলে শিশু যে রুমে ঘুমায়, সেই রুমের কোনায় একটি রিডিং টেবিল দিয়ে দিন। রিডিং টেবিলে তাক সিস্টেম থাকলে ভালো হয়। টেবিলের গায়ে শিশুর প্রিয় কার্টুন চরিত্রের স্টিকার লাগিয়ে দিন। অনেক সময় দেখা যায়, মনের মতো পরিবেশের অভাবেও শিশু পড়তে চায় না। এ রুমে তার খেলনাগুলোও রাখতে পারেন। আর সবচেয়ে ভালো তারই সুন্দর সুন্দর সেরা সিঙ্গেল ছবিগুলো বড় করে প্রিন্ট করে ওই রুমের দেয়ালে লাগিয়ে দিন।
৫. প্রতিদিনই শিশুদের জানান (এবং আপনি নিজেও বিশ্বাস করুন) সে একটি স্মার্ট শিশু ও ভালো পড়ুয়া
কারণে-অকারণে শিশুকে উৎসাহ দিন। শিশুর সার্বিক বিকাশে উৎসাহ দেয়ার বিকল্প কিছু নেই। শিশুকে জানান, সে খুব ভালো পড়তে পারে এবং তার পড়ার আগ্রহ অন্যদের চেয়ে বেশি। তুমি যত বেশি পড়বে, অন্যদের চেয়ে তত বেশি জানবে ও তত বেশি এগিয়ে যাবে। তাকে বলুন, তুমি খুব স্মার্ট। আর স্মার্টদের অনেক কিছু জানতে হয়, তাই তাদের অনেক কিছু পড়তে হয়।
৬. শিশুকে তার শিক্ষক ও স্কুল সম্পর্কে পজিটিভ কথা বলুন
অনেক শিশুরই স্কুলভীতি থাকে। তারা অনেক সময় ধরে নেয়, স্কুল মানেই কড়া কড়া টিচারের বকুনি আর দুষ্টু ক্লাসমেটদের দুষ্টুমির শিকার হওয়া। এতে করে তাদের মধ্যে শুরুতেই স্কুলের প্রতি অনীহা দেখা দিতে পারে, যার প্রভাব পড়তে পারে পড়ালেখার ওপর। তাই শিশুদের স্কুলে দেয়ার আগে স্কুল ও টিচার সম্পর্কে ভালো কথা বলুন। তাদের জানান, স্কুলে তুমি যেমন ভালো ভালো খেলার সাথী পাবে, তেমনি পাবে তোমার যত্ন নেয়ার জন্য ভালো ভালো টিচার।
৭. পড়ার পাশাপাশি শিশুদের লিখতে উৎসাহ দিন
পড়ার পাশাপাশি তাদের যে কোনো কিছু লিখতে উৎসাহ দিন। তাকে নিজের থেকে ছড়া মিনি গল্প, কিংবা আজ স্কুলে সে কী কী করল তা লিখতে বলুন। এতে করে তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। তার লেখায় অনেক ভুল থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই তাকে সবার আগে চমৎকার লেখার জন্য বাহবা দিয়ে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ভুলগুলো ধীরে ধীরে শুধরে দিন। হতে পারে, আপনার শিশুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বড় কোনো লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, গীতিকার, জার্নালিস্ট কিংবা কলামিস্টের প্রতিভা!
৮. শিশুর সঙ্গে কথা বলুন, তাকে প্রশ্ন করুন, তার কাছ থেকে প্রশ্ন শুনুন
শিশুর সঙ্গে তার পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কথা বলুন। সে কী কী বিষয়ে পড়তে উৎসাহবোধ করে অথবা আপনি তাকে কোন কোন বিষয় পড়ালে সে আনন্দ পায়, তাকে প্রশ্ন করে জেনে নিন। তার পছন্দের বিষয়েই আপনি বেশি করে মনোনিবেশ করুন। শিশু যদি পড়ার মধ্যে আনন্দ একবার পেয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে আপনার জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি। পাশাপাশি আপনি এও তার কাছ থেকে জেনে নিন, কী কী বিষয় পড়তে তার ভালো লাগে না।
৯. মাঝেমধ্যে শিশুর সঙ্গে তার স্কুলে গিয়ে তার বিষয়ে টিচারদের সঙ্গে কথা বলুন
যখন সময় পাবেন, কিংবা শিশুকে স্কুলে দিয়ে বা নিয়ে আসার সময় তার বিষয়ে টিচারদের সঙ্গে কথা বলুন। তার ক্লাস পারফরম্যান্সের বিষয়ে আলাপ করুন। কিংবা তার বিষয়ে কোনো কথা জানানোর থাকলে তা টিচারদের অবহিত করুন। এতে করে টিচাররা তার বিষয়ে সঠিক যত্নটি নিতে পারবেন। আর আপনার শিশুরও এটা দেখে ভালো লাগবে, তার বিষয়ে আপনি কতটা যত্নবান।
১০. তাকে পুরস্কৃত করুন
সুযোগ পেলেই শিশুকে পুরস্কৃত করুন। নতুন নতুন খেলনার বায়না তো শিশুদের লেগেই থাকে। আর সেটা তাকে যেহেতু কিনে দিতেই হয়, তাই সে কিছুর বায়না করার আগেই তাকে বলুন-তুমি যদি এ বইটা সুন্দর করে পড়া শেষ করতে পারো তাহলে তোমার জন্য সুন্দর একটি গিফট রয়েছে। নিজ চোখেই না হয় পরখ করে দেখুন যে এ টিপসটা কতটা কার্যকর! কিংবা একটি বই শেষ করার পর হঠাৎই তার সামনে এক বাটি আইসক্রিম দিয়েই দেখুন না! এগুলোই ছিল বাছাই করা সেরা সব টিপস। লেট ইজ বেটার দ্যান নেভার! তাই, আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই শিশুদের পড়ার বিষয়টিতে মনোযোগ দিন।
No comments:
Post a Comment